অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
গরমের দুপুরে দোতলা বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মহিলা। তাঁকেই প্রশ্ন করলাম, ‘‘দাদা বাড়িতে আছেন?’’
পায়ের জুতো থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করার পরে মহিলা হাঁক পাড়লেন, ‘‘শুনছো, তোমায় এক জন খুঁজতে এসেছেন।’’ ঘরের ভিতর থেকে জবাব এল, ‘‘আসছি।’’
বাড়ির সদর দরজা আগলে দাঁড়িয়ে ওই মহিলা। গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কোথা থেকে আসা হচ্ছে? বাজি কিনবেন, না বড়সড় কিছু? সবই মিলবে এখানে।’’
মহিলার সঙ্গে কথার ফাঁকেই বেরিয়ে এসেছেন গৃহকর্তা। পরনে লুঙ্গি, আদুর গায়ে ঝুলছে গামছা। দক্ষিণ শহরতলির চম্পাহাটির সোলগোলিয়ার এই ব্যক্তির নাম ধরা যাক, বাজিদাদা।
হাত জোড় করে বললাম, ‘‘কালীপুজোর সময়ে এসেছিলাম। চিনতে পারছেন? আপনি বলেছিলেন, আমরা সারা বছর বাজি তৈরি করি। যখন প্রয়োজন মনে করবেন, চলে আসবেন। তাই এসেছি।’’
‘আসুন আসুন’, সসম্মানে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন বাজিদাদা। স্ত্রীকে চা করতে বলে, একটা মোড়া এগিয়ে দিলেন বসতে। তার পরেই প্রশ্ন, ‘‘কোথা থেকে আসছেন?’’ বললাম, ‘‘সেই শিলিগুড়ি।’’
দক্ষিণ শহরতলির চম্পাহাটির মূল রাস্তা থেকে একটু ঘুরপথে গেলেই সোলগোলিয়া। শব্দবাজির আঁতু়ড়ঘর বলে রাজ্য জুড়ে এই এলাকার একটা প্রচার রয়েছে। চম্পাহাটি উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সব এলাকার বাজি ব্যবসায়ীদের তীর্থক্ষেত্র বলা যেতে পারে। বাংলার আতসবাজির বাজার প্রায় দখলে নিয়ে নিয়েছে শিবকাশী। কিন্তু শব্দবাজির বাজারে দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটি-মহেশতলার নুঙ্গি এখনও এক নম্বরে।
চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘বাজির কথা ছাড়ুন। অন্য কী আছে বলুন! সে সব মিলবে?’’ হাসলেন বাজিদাদা। হাত তুলে অভয় দিলেন, ‘‘সব পাবেন, এখন মূলত এই কাজই করি। যেমন অর্ডার আসে, তেমন মাল তৈরি হয়। চলুন, কারখানায়।’’
দোতলা বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাদা-র কারখানা। আনুমানিক দশ ফুট বাই কুড়ি ফুটের ঘর। চারপাশে বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ। এক দিকে থরে থরে সাজানো বোমার প্যাকেট। সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা বোমা মাটিতে সার দিয়ে রাখা। অন্য দিকে, গোটা দশেক ভিজে চটের বস্তা চাপা দিয়ে রাখা রয়েছে প্লাস্টিকের কয়েকটি ড্রাম। এর মধ্যেই মাথা নিচু করে বোমা বেঁধে চলেছেন গোটা দশেক কর্মী।
কর্মীদের মধ্যে কয়েক জন শিশুও রয়েছে। তাদের দিয়ে মশলা আর রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। তার পরে কাগজ অথবা মাটির খোলে ভরে সুতলি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে বোমা।
ঘরে ঢুকেই বোমা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরদের বাজিদাদা প্রশ্ন করলেন, ‘‘বস্তায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল দিচ্ছিস তো বাবা?’’ বছর বারোর এক বালক জবাব দিল, ‘‘হ্যাঁ দিচ্ছি। টেবিল ফ্যানও চালিয়ে দিয়েছি।’’ ‘‘কী আছে ওই ড্রামের ভিতরে?’’—জানতে চাইলাম বাজিদাদার কাছে। উত্তর এল, ‘‘কেমিক্যাল রয়েছে। ডেঞ্জারাস জিনিস, দাদা। সব সময়ে ঠান্ডা রাখতে হয়। একটু গরম হলেই নিজে নিজে জ্বলে উঠে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে। আর দেখছেন তো, কত তৈরি বোমা আর ছোট ছোট বাজি রয়েছে এখানে। সব একসঙ্গে ফেটে যাবে। কারখানা সমেত আমার বাড়িটাও উড়ে যাবে।’’ নিজের কথার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েই বাজিদাদা হাত নেড়ে বললেন, ‘‘কয়েক দিন আগেই পিংলায় এ রকম বিস্ফোরণের কথা শুনেছেন তো?’’ তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, ‘‘না তো!’’ বাজিদাদা বলতে লাগলেন, ‘‘তবে শুনুন, কালীপুজোর সময়ে সাধারণ চকোলেট বোমা তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের কাছে সারা বছরই বোমার বরাত আসে। সবাই এসে বলে, ভাল আওয়াজের বোমা চাই। তাই বিকট শব্দ ও ধোঁয়ার জন্য নাইট্রো-গ্লিসারিন ও পটাশিয়াম ক্লোরেট ব্যবহার করি। ডিনামাইটে লাগে এই কেমিক্যাল। কিন্তু এ সব জিনিস ২০ ডিগ্রির (সেন্টিগ্রেড) নীচে রাখতে হয়। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি হয়ে গেলেই ফটাস। পিংলাতেও তা-ই হয়েছিল।’’
শুধু পিংলাতেই নয়, কয়েক মাস আগে তাঁর এলাকাতেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে বলে জানালেন বাজিদাদা। কেমন সেই ঘটনা? দাদা বললেন, ‘‘কারখানার মালিক আমাদের গ্রামের তপন সর্দার। বিস্ফোরণের সময়ে তপন কারখানাতেই ছিল। ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছে। কয়েক জন কারিগরও জখম হয়েছিল। ওই কারখানা এখন বন্ধ।’’ পুলিশ কেস হয়নি? প্রশ্ন শুনে হাসেন দাদা। ‘‘এ সব তো মাঝেমধ্যেই হয়। কেউ জানতেই পারে না। জখমদের বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসা করিয়ে নিই।’’ আর পুলিশ? দাদার চটজলদি জবাব, ‘‘সব ঠিকঠাক আছে। কোনও চিন্তা করবেন না!’’
কারখানার মালের শুদ্ধতা, তাদের ঝুঁকির কথা স্বচক্ষে দেখিয়ে দাদা ফের ঢুকলেন বাড়িতে। হাতে পেন আর প্যাড নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘বলুন, আপনার কী লাগবে? বোমা না চকোলেট? তাড়াতাড়ি বললাম, ‘চকোলেট।’ এ বার প্রশ্ন, ‘‘কতটা?’’ বললাম, ‘‘পাঁচশোর মতো, কয়েক দিন কলকাতায় আছি। শিলিগুড়িতে ফেরার আগের দিন ডেলিভারি নেব।’’ পাঁচশো টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে বললাম, ‘‘বায়না রাখুন। শনিবার মাল রেডি রাখবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy