কী ‘পরামর্শ’ রাজ্যপালকে দিয়েছিলেন সুকান্ত? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শনিবার সকালে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। ঘণ্টা দু’য়েক বৈঠক হয়। বেরিয়ে এসে সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘এক এক জনের কাজের স্টাইল (ধরন) এক এক রকম।’’
তখন মনে হয়েছিল, বিজেপি পরিষদীয় দলের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাত নিয়ে আনন্দের হয়ে সওয়াল করছেন সুকান্ত। কিন্তু বৈঠক শেষের আধ ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্যপাল রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারকে ডেকে কথা বলেছেন (যা সেদিনই জানিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন)। কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের পরে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে নবান্ন, মন্ত্রীর কাছে তা জানতে চেয়েছিলেন রাজ্যপাল আনন্দ। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা থেকে লোকাযুক্ত নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্যপাল বিবৃতি জারি করেন। কড়া ভাষায় জানিয়েছিলেন, সবকিছুর উপরেই ‘নজর’ রয়েছে তাঁর। তার পরেই রবিবার রাতে জানা যায়, তাঁর প্রধান সচিব পদে থাকা আইএএস নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ নবান্নে পাঠিয়ে দিয়েছেন আনন্দ।
এই ঘটনাপ্রবাহের ফলেই জল্পনা তৈরি হয়েছে— শনিবেলার দু’ঘণ্টার বৈঠকে সুকান্ত আনন্দকে কী এমন বলেছেন যে, ঘড়ির কাঁটা সরতে না সরতেই ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠেছেন আনন্দ? সুকান্ত রাজভবন থেকে বেরিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ভাবে যেটুকু বলেছিলেন, তার পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে গেরুয়া শিবির সূত্রের খবর, কিছু ‘পরামর্শ’ রাজ্যপালকে দিয়েছিলেন সুকান্ত।
অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশেই সুকান্তের রাজভবন যাত্রা। আবার বিজেপিরই একটি অংশের বক্তব্য, সুকান্তের কাছে ডাক এসেছিল রাজভবন থেকেই। অন্য আর এক পক্ষের বক্তব্য, আনন্দ-সুকান্ত মিলেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে চাইছিল রাজভবন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্তও চাইছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে রাজ্যপালের দূরত্ব কমুক। কারণ, পরিষদীয় নেতা এবং সাংবিধানিক প্রধানের মধ্যে সংঘাতের আবহ না থাকাই কাম্য।
গেরুয়া শিবির সূত্রের দাবি, সুকান্ত মূলত পাঁচটি বিষয়ে আনন্দকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে ‘পরামর্শ’ দিলেও সুকান্তের গলায় সুর ছিল ‘আর্জির’।
প্রথমত, রাজ্যপাল সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে তাঁর সঙ্গে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, এপিজে আবদুল কালাম, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। উইনস্টন চার্চিল এবং মিল্টনের সঙ্গেও এক আসনে বসান বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। আনন্দ বলেছিলেন, ‘‘যে সকল রাজনীতিবিদ সাহিত্যেও অনন্য নজির রেখেছেন, মমতা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্বের জন্য কুর্নিশ জানাই।’’ এ ভাবে ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা না করারই পরামর্শ দিয়েছিলেন সুকান্ত। মমতার বিভিন্ন ‘কাজকর্ম ও বক্তব্য’ সম্পর্কেও রাজ্যপালকে অবহিত করেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, রাজ্যে যে সব দুর্নীতির তদন্ত চলছে সেগুলি নিয়ে রাজ্যপালকে অবহিত করার পাশাপাশি ওই সব বিষয়ে আনন্দকে ‘সরব’ হওয়ারও পরামর্শ দেন সুকান্ত। এমনও বলেন, রাজ্য সরকারের এক প্রাক্তন মন্ত্রী জেলে। আরও বেশ কয়েকজন নেতা শিক্ষকনিয়োগ দুর্নীতি থেকে অন্যান্য অভিযোগে জেলে রয়েছেন। তাতে রাজ্যের মানুষ ক্ষুব্ধ। এই সময়ে রাজ্যপাল এ সব বিষয়ে নীরব থাকলে রাজভবনের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের চোখে খাটো হয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যাঁরা বসে রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ‘রাজনৈতিক যোগাযোগ’-এর অভিযোগ রয়েছে বলে রাজ্যপালকে জানান সুকান্ত। সেই সঙ্গে বলেন, বিধানসভায় বিল পাশ হলেও রাজ্যের মানুষ চান না, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আচার্য’ পদে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বসুন। বিশেষত, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি সামনে এসেছে এবং মুখ্যমন্ত্রী তা নিয়ে চুপ করে রয়েছেন দেখে রাজ্যবাসী অখুশি। আগের রাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাতের জন্যই ওই পদক্ষেপ করেছিল তৃণমূল। এখন সেই দাবি মেনে নিলে বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কে অপমান করা হবে।
চতুর্থত, কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজ্য সরকার বনাম কেন্দ্র সংঘাত চলছে। ১০০ দিনের কাজে ভুয়ো জব কার্ড, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় প্রাপকদের তালিকায় ‘অযোগ্য’দের রাখা এবং মিড ডে মিলের টাকা অন্য খাতে খরচ করা নিয়ে রাজ্য জুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রাজভবনেরও উচিত এ সব নিয়ে ‘সরব’ হওয়া। এই রাজ্য সরকারের দুর্নীতি নিয়ে বিজেপি যে লড়াই করছে, তা সাধারণের সাংবিধানিক অধিকারের লড়াই। সেখানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাজভবনের মতামতেরও গুরুত্ব রয়েছে।
পঞ্চমত, বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে কী ভাবে বিজেপি কর্মীদের উপরে আক্রমণ করা হয়েছে, কত কর্মী এখনও ঘরছাড়া, কত মামলা চলছে, তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রাজ্যপাল আনন্দকে দেন সুকান্ত। সেই সঙ্গে বলেন, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে আবার সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। বিজেপি ‘ভয়মুক্ত নির্বাচন’ চাইছে। সেই স্বরে যেন রাজভবনও সুর মেলায়। বাংলায় শান্তিস্থাপনের জন্য রাজভবনের কেমন ভূমিকা হওয়া উচিত, তা নিয়েও নিজের ভাবনার কথা জানান সুকান্ত।
ঘটনাচক্রে, সুকান্তের সঙ্গে বৈঠকের পর শনিবার রাজভবন যে বিবৃতি জারি করেছিল, তাতেও এই সব বিষয়ে আলোচনার ইঙ্গিত ছিল। তবে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রধান সচিব পদ থেকে নন্দিনীর অপসারণ নিয়ে আনন্দের সঙ্গে সুকান্তের কোনও কথা হয়নি। ওই সূত্রের দাবি, ওই সিদ্ধান্ত রাজ্যপাল আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন। গত শুক্রবারই ওই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। একই ভাবে লোকায়ুক্ত নিয়েও রাজ্যপালকে কোনও পরামর্শ দেননি সুকান্ত। তিনি রাজভবনে গিয়েই বিষয়টি জানতে পারেন। শনিবার তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই যে লোকায়ুক্তের কথা বললাম, আমাদের রাজ্যপাল যে সেটা অসাংবিধানিক বলে রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছেন, তা সংবাদমাধ্যমের সামনে আনেননি তিনি।’’ পাশাপাশিই সুকান্তের সংযোজন ছিল, ‘‘আগামী দু’এক দিনে আরও অনেক কিছু দেখতে পাবেন।’’
তিনটি বিষয় ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। পঞ্চায়েত মন্ত্রীকে তলব, রাজ্য নিয়ে কড়া বিবৃতি জারি করা এবং নন্দিনীর অপসারণের সুপারিশ। আরও তিনটি পদক্ষেপ নাকি শীঘ্রই দেখা যেতে পারে—
১. কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে ওঠা অভিযোগ যে সব জায়গায় বেশি, সেখানে নিজে যেতে চাইতে পারেন রাজ্যপাল।
২. শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে কথাবার্তা চালাতে পারেন।
৩. পঞ্চায়েত ভোট এবং রাজ্যের সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে তিনি কী কী চাইছেন, তা নবান্নকে জানাতে পারেন।
বিজেপি আপাতত তাকিয়ে আছে সেদিকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy