মুখে আনন্দ! মনে আশঙ্কা!
বিহারে নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ ও সনিয়া গাঁধীর দলের ত্রিমুখী হামলায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা পর্যুদস্ত হওয়ার পরে এমনই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার স্রোত বইছে এ রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে! প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্যই উল্লসিত। তাঁদের আশা, মনোবলে ধাক্কা খেয়ে বিজেপি আপাতত বাংলায় তেমন আঁচড় কাটতে পারবে না। তৃণমূল সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলার বদলে বরং সংসদ-সহ জাতীয় রাজনীতিতে মমতার দলের মন বুঝেই চলতে হবে মোদীর দলকে।
কিন্তু আশঙ্কাও আছে বিস্তর! বিজেপি-র হাল একেবারে বেহাল হয়ে পড়া মানে বাংলায় মমতার মূল চ্যালেঞ্জার হিসাবে সামনে এসে দাঁড়াবে বামেরাই। বিরোধী ভোট ভাগাভাগি কমবে। আর বিহারে নীতীশ-লালুর সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেস যদি পরোক্ষ সমঝোতাও গড়ে তুলতে পারে, তা হলে তো বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের জন্য আরও বিপদ! উল্লাসের নীচেই তৃণমূলের অন্দর মহলে তাই বইতে শুরু করেছে ভাবনার চোরাস্রোত!
প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূল নেতৃত্ব আশঙ্কার কথা সামনে আনছেন না। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবার সকালেই নীতীশ ও লালুকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করে বলেছেন, ‘এই জয় সহিষ্ণুতার। এটা অসহিষ্ণুতার পরাজয়’। নীতীশ-লালুও টুইটারে তৃণমূল নেত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। লালুপ্রসাদ তো বলেই দিয়েছেন, ‘‘মোদী এর পরে বাংলায় পা দিতে চাইছিলেন! আমরা বিহারেই ওঁকে রুখে দিয়েছি!’’ মমতার দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনও তাঁর দলনেত্রীর সুরেই আনন্দিত— ‘‘বিজেপি হারল, দেশ রক্ষা পেল! বিহারে বিজেপি তৃতীয় হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তারা চতুর্থ হবে!’’
বিহারের তখত দখল করতে পারলে পাশের বাংলায় ঘাঁটি গেড়ে বসার পরিকল্পনা ছিল মোদী-অমিত জুটির। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে অক্সিজেন নিয়ে বাংলায় বিজেপি-র হইচইও বাড়ত। হয়তো এই রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে তাল রেখে সারদা তদন্তের গতিও বাড়িয়ে দেওয়া হতো বলে তৃণমূলের একাংশের আশঙ্কা। দিল্লির পরে বিহারে ধাক্কা খেয়ে বিজেপি-র মনোবল দুর্বল হলে তাই স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূলের লাভ! সেই হিসাব থেকেই এ দিন বিবৃতি জারি হয়েছে তৃণমূলের তরফে। পশ্চিমবঙ্গে যে বড় বিহারি ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে, তা হিসাবের মধ্যে রাখছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের অন্দরে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে, বিহারের ‘প্রভাব’ ধরে রাখতে এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে নীতীশ ও লালুর দলকে এক-দু’টি আসন ছেড়ে দেওয়া যায় কি না।
কিন্তু এ সব ভাবনার আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে গভীর অস্বস্তি! মোদীর দলের বিপর্যয়ে আনন্দের কথা বললেও তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে মনে জানেন, বিজেপি-র উত্থানে এ রাজ্যে আসলে তাঁদের লাভ! লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এ রাজ্যে পেয়েছিল ১৭% ভোট। যা মূলত এসেছিল বামেদের ঘর ভেঙে। তাতে তৃণমূলের কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং, তারা ৩৪টি আসন জিতে ময়দান ছেড়েছিল! পরের দেড় বছরে বাংলায় বিজেপি হাওয়া ক্রমশ স্তিমিত হয়েছে। কলকাতা-সহ পুরভোটে (যদিও সে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আছে শাসক দলের বিরুদ্ধে) বিজেপি-র ভোট নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮%-এ। বিজেপি-র বাড়তি ভোট আবার ফিরতে শুরু করেছে বামেদের দিকে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, এই অবস্থায় বিহারে ভাল ফল করতে পারলে তার ঝাপটায় এ রাজ্যে বিজেপি-র উদ্যম বাড়তো। এবং বাংলায় বিজেপি-র ভোট বাড়লে বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হতো। তাতে তৃণমূলেরই লাভ! আর বিজেপি আরও হতোদ্যম হয়ে পড়া মানে বিরোধী পরিসরের মূল চাবিকাঠি চলে যাবে বামেদের হাতে। তাদের সঙ্গে শাসক দলের ব্যবধান কমে আসার সম্ভাবনা তখন অঙ্কের নিয়মেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে! মমতা-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক সাংসদ যে কারণে বলছেন, ‘‘বিজেপি তো এ রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে পারতো না। তারা ভোটের শতাংশ বাড়িয়ে বিরোধী পরিসরে আরও প্রভাব ফেলতে পারতো। কিন্তু এখন সেটাও হবে না!’’
আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আশা দেখছে সিপিএম। বিহারের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র তৃণমূলকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষই জয়ী হয়। এ রাজ্যের শাসকদেরও তা মনে রাখা উচিত। মোদীজি গরু-গরু করে বিহারে গো-হারা হয়েছেন! এ বার দিদিকেও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিপদে পড়তে হবে।’’ সিপিএমের অঙ্ক বলছে, বিহারে জিততে না পারার ফলে সংসদে কাজ চালাতে তৃণমূলের মতো দলের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হবে মোদী সরকারকে। আর যত সেটা হবে, ততই মোদী-দিদি ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে প্রচার চালিয়ে সংখ্যালঘুদের কাছে টানার চেষ্টা করতে পারবে আলিমুদ্দিন।
শুধু প্রচারই নয়, কয়েক মাসের মধ্যে বাংলায় দিদির সরকারকে ধাক্কা দিতে গেলে কৌশলগত ভাবে তাঁদের যে আরও কয়েক কদম এগোতে হবে, তা-ও বুঝতে পারছেন সিপিএম নেতৃত্ব। বিহারে যদি এত কালের দূরত্ব মুছে নীতীশ-লালু কাছাকাছি আসতে পারেন এবং কংগ্রেসের হাত ধরতে পারেন, তা হলে বাংলায় কী হবে? বিধানসভার প্রয়াত প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে এ দিনই কলকাতায় এসে সঙ্কেত পড়ে নিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁর মম্তব্য, ‘‘রাজনীতি পাটিগণিত নয়। এখানে দুয়ে-দুয়ে সব সময় চার হয় না! বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে বিহারের মানুষ চেয়েছিলেন বলেই লালু-নীতীশ এক হয়েছিলেন। বাংলাতেও মানুষ যা চাইবেন, তা-ই হবে!’’ দু’দলের ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক, শিলিগুড়িতে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গড়তে বাম-কংগ্রেস যে হাত মেলাচ্ছে, সেই দৃষ্টান্ত মাথায় রাখছেন ইয়েচুরি। আর এ দিন থেকেই সোশ্যাল সাইটে সিপিএম সমর্থকদের একাংশ গত পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক কৌশলগত পর্যালোচনা রিপোর্টের অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে দেখাতে শুরু করেছেন, রাজ্যওয়াড়ি পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ কী ভাবে সেখানে খুলে রাখা আছে!
দলের সাধারণ সম্পাদকের কথারই প্রতিধ্বনি করে শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যও বলছেন, ‘‘বিহার যেমন দেখাল বিজেপি-কে হারানো সম্ভব, শিলিগুড়িতে তেমন ভাবেই আমরা আগে দেখিয়েছি তৃণমূলকে হারানো যায়! মানুষ কী চাইছেন, নেতা হিসাবে আমাদের সেটাই গভীর ভাবে ভাবতে হবে!’’ মানুষের এই ‘চাপে’র কথা উপলব্ধি করছেন কংগ্রেস নেতৃত্বও। বিহারের ফলের জন্য কংগ্রেসের সংখ্যালঘু শাখার নেতা খালেদ এবাদুল্লারা যেমন শহরে বাজি ফাটিয়ে আনন্দ করেছেন, তেমনই বর্ষীয়ান নেতা মানস ভুঁইয়া মন্তব্য করেছেন, ‘‘বিহারে মানুষের রায় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে। আমাদের রাজ্যেও লড়াই চলছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, শাসক দলের আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে। এখানে বিহারের জোটের কোনও প্রভাব পড়বে না, এটা তো বলতে পারি না!’’
এমতাবস্থায় কী বলছে রাজ্য বিজেপি? বিহারের ধাক্কায় এ দিন সুনসান হয়ে গিয়েছে দলের রাজ্য দফতর। রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ছিলেন না। দলের তরফে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তরুণ নেতা রীতেশ তিওয়ারিকে! যিনি দাবি করেছেন, ‘‘লোকসভা ভোটের পরে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে বিজেপি জিতেছে। কাশ্মীরে ভাল ফল করেছে। দিল্লিতে হেরেছে। আবার ঝাড়খণ্ডে জিতেছে। এই ধারা দেখেই বলা যায়, এক রাজ্যের ফলের প্রভাব অন্য রাজ্যে পড়বে, এমন কোনও সূত্র নেই।’’ বলছেন বটে। বিশ্বাস করছেন কি?
(তথ্য সহায়তা: রোশনী মুখোপাধ্যায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy