খাওয়াদাওয়ার পরিদর্শনে অধ্যক্ষা। ছবি: শুভ্র মিত্র
অধ্যক্ষার ঘরে রাখা একটা বাক্স। কোনও চাপাচাপি নেই। ইচ্ছেমতো যে যতটুকু পারেন, টাকা ফেলছেন সেই বাক্সে। এ টাকায় পুজো হবে না। হবে না কলেজের কোনও অনুষ্ঠান। এই টাকায় তৈরি হয়েছে ‘অন্নসত্র’। দুঃস্থ পড়ুয়াদের খাবারের জন্য।
কলেজে কলেজে ছাত্র রাজনীতির দাপাদাপি, শিক্ষক হেনস্থার বারোমাস্যা ছাপিয়ে বাঁকুড়ায় বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজ ফিরিয়ে এনেছে শিক্ষক-পড়ুয়া স্নেহ-বন্ধনের পুরনো ছবি।
অল্প কিছু দিন আগের কথা। রোজ কলেজে এসে ক্লাসঘরের কোণের বেঞ্চে বসত একটি মেয়ে। মন দিয়ে পড়া শুনত। হঠাৎ এক দিন ক্লাসেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালের ডাক্তার জানালেন, অনেক দিনের অপুষ্টি। খোঁজ নিয়ে শিক্ষকেরা জানতে পারলেন, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পরিবারটিতে। অধিকাংশ দিন দাঁতে কুটোটিও না কেটে কলেজে চলে আসে সে। তার পরেই এল ওই ভাবনা। অধ্যক্ষা স্বপ্না ঘোড়ই জানান, দিন পনেরো আগে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা স্থির করেছেন, দুঃস্থ পড়ুয়াদের জন্য কলেজেই তৈরি করা হবে ‘মিড ডে মিলের’ মতো একটা ব্যবস্থা। পরিচালন সমিতিতে সে প্রস্তাব পাড়তেই উৎসাহ দেখান সভাপতি শ্যামল সাঁতরা। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শ্যামলবাবুর কথায়, ‘‘আমি ওই কলেজেই পড়েছি। বাড়িতে অভাব ছিল। আমিও বহু দিন না খেয়ে ক্লাসে গিয়েছি। কথাটা শুনেই সেই সব দিন মনে পড়ে গিয়েছিল।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হস্টেলে বছর চারেক আগেও ‘ফ্রি মেস’-এর ব্যবস্থা ছিল। দুঃস্থ ছাত্রদের সারা মাসের খাওয়ার খরচ হস্টেলের অন্য ছাত্ররা ভাগ করে নিতেন। এর ফলে সবার ভাগে সামান্য কিছু বাড়তি খরচ বরাদ্দ হতো। বিভিন্ন কারণে সেই ব্যবস্থা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
রামানন্দ কলেজে ছাত্র ও শিক্ষকরা মিলে এখন জনা চল্লিশ দুঃস্থ পড়ুয়ার নামের তালিকা তৈরি করেছেন। দুপুর দেড়টা থেকে তিনটে পর্যন্ত হস্টেলে তাদের জন্য খাবারের আয়োজন থাকছে। প্রতিদিন তত্ত্বাবধানে এক জন করে শিক্ষক। সম্প্রতি কলেজে গিয়ে দেখা গেল, তৃতীয় বর্ষের সঙ্গীতা, প্রথম বর্ষের প্রতিমা, তৃতীয় বর্ষের জয়দেবরা খেতে বসেছেন। পাতে পড়েছে ভাত, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি। শেষ পাতে মিষ্টিও। রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অভিজিৎ মণ্ডল জনে-জনে জিজ্ঞাসা করে গেলেন, সবার পেট ভরেছে কি না।
শিক্ষকদের উদ্যোগে অভিভূত পড়ুয়ারাও। তাঁদের কারও পরিবারের আয়ের উৎস এক চিলতে জমির ফসল। কারও বাবা দিনমজুর। আসনাশোল গ্রাম থেকে কলেজে আসেন প্রথম বর্ষের সদানন্দ। বাড়ি থেকে বেরোতে হয় সকাল আটটায়। অত সকালে খেয়ে আসা হয় না। অধিকাংশ দিনই কিনে খাবার মত টাকাও থাকে না পকেটে। সদানন্দ, সঙ্গীতা, প্রতিমা, জয়দেবরা বলছিলেন, ‘‘এক বেলার খাবারের সঙ্গে কতটা ভালবাসা মিশে আছে, সেটাই রোজ বুঝছি এখন।’’
হস্টেলের কর্মীরাই অন্নসত্রের জন্য রান্না করছেন। সুদর্শন দাস, স্বপন মাঝিরা বলেন, ‘‘একটু বাড়তি চাপ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এমন একটা উদ্যোগে সামিল হওয়ার সুযোগ ছাড়তে চাইনি!’’ যে ছাত্রীর কথা ভেবে এই আয়োজনের সূত্রপাত, সে কি খেতে বসছে সবার সঙ্গে সারি বেঁধে? অধ্যক্ষা জানান, ওই ছাত্রী অসুস্থতার জন্য আপাতত কলেজে আসছে না। সেরে উঠলে ফের যাতে সে অসুস্থ না হয়, দেখবেন তাঁরা।
অন্নসত্র দীর্ঘমেয়াদে চালিয়ে যাওয়া যাবে তো? স্বপ্নাদেবীর দাবি, কলেজ খোলা থাকে এমন দিনগুলি ধরলে জনা চল্লিশ-পঞ্চাশ পড়ুয়াকে খাওয়ানোর জন্য সারা বছরে কমবেশি দেড় লক্ষ খরচ হতে পারে। সেই টাকার বড় অংশ ইতিমধ্যেই বাক্সে জমা হয়েছে। যদি চাঁদা আসায় ভাটা পড়ে, তখন কী হবে? অধ্যক্ষা জানালেন, কলেজে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী। তেমন পরিস্থিতি হলে তাঁদের জন্যও একটি বাক্স রাখা হবে। সামান্য চাঁদাতেই তাঁরা সহপাঠীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy