বৈদ্যুতিন পণ্য কিংবা দীপাবলির আলোয় ইতিমধ্যেই থাবা বসিয়েছে চিনের পণ্য। এ বার ‘চিনের কোপ’ পড়ছে রাজ্যের তাবড় পক্ষীকূলের ডানাতেও!
দমদম গোরাবাজারের গাছ থেকে ঝুলে ছিল পেঁচাটা। স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা তাকে নামানোর পরে দেখলেন, পাখিটির ডানা যেন কেউ ধারালো কিছু দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে! প্রাথমিক শুশ্রূষার পরে তাকে বন দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
গত বছর স্বাধীনতা দিবসেও একই রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ধর্মতলা এলাকার একটি অফিসের কর্মীদের। রাস্তার পাশে দোকানের কার্নিশে আহত হয়ে পড়েছিল একটি বাজপাখি। তার ডানাতেও ছিল ধারালো ‘অস্ত্রে’র দাগ!
পাখিপ্রেমীরা বলছেন, ইদানীং কলকাতা এবং রাজ্যের বেশ কিছু জায়গাতেই একের পর এক পাখির ডানায় এমন আঘাত মিলছে। যার কারণ হিসেবে তাঁরা দায়ী করছেন চিনে মাঞ্জা সুতোকে (চলতি কথায় চাইনিজ মাঞ্জা)। দমদমের সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত দুলাল দেব বলছেন, ‘‘শুধু পেঁচা নয়, ইদানীং বেশ কিছু কাক, পায়রার ডানাতেও এই ঘুড়ির সুতোর আঘাত নজরে এসেছে। কয়েকটি মারাও গিয়েছে।’’ হাওড়ার পাঁচলা এলাকায় নানা প্রজাতির পাখির বাসস্থান রয়েছে। ওই ব্লকের জীববৈচিত্র কমিটির সভাপতি ইন্দ্রজিৎ আদক বলছেন, সেখানেও এই সুতোয় বিপদে পড়ছে পাখিরা। অনেকে মারাও যাচ্ছে।
এই বিপদ অবশ্য মানুষকেও রেহাই দিচ্ছে না। সম্প্রতি দিল্লিতে মোটরবাইকে চেপে যাওয়ার সময়ে এই মাঞ্জাসুতোয় গলা কেটে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে দুই শিশুর। মারা গিয়েছেন আর এক ব্যক্তিও। তার পরেই দিল্লিতে এই সুতো বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করেছে প্রশাসন। নিষিদ্ধ হয়েছে মুম্বই ও চেন্নাইতেও। এ রাজ্যে এখনও কেউ মারা না গেলেও আহত হয়েছেন অনেকেই। যার উদাহরণ পাঁচলার ইন্দ্রজিৎ নিজেই। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় এই সুতোর টানে গলায় গভীর ক্ষত হয়েছিল তাঁর। বলছেন, ‘‘সুতোটা আর একটু চেপে বসলেই আমার গলার নলি কেটে যেত!’’
ঘুড়ি বিক্রেতারা বলছেন, ‘চাইনিজ মাঞ্জা’ মানেই যে চিনে তৈরি হওয়া মাঞ্জাসুতো এমনটা নয়। এক সময়ে হয়তো চিন থেকে আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেশেই এই সুতো তৈরি হচ্ছে। কারও কারও মতে, যে ভাবে গড়পড়তা জিনিসের বাইরে কিছু তৈরি হলেই চিনে তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়, এখানেও সেই ভাবে সুতোর গায়ে চিনে তকমা পড়ে গিয়েছে। লোকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে তা।
ঘুড়ি বিক্রেতাদের অনেকের বক্তব্য, এই মাঞ্জাসুতো অনেক বেশি টেঁকসই। তার উপরে আবার দামও কম। তাই এই সুতোর চাহিদা বেশি। তবে এই সুতো যে বিপজ্জনক, তা মেনে নিচ্ছেন বিক্রেতারাই। বলছেন, শুধু সামান্য অসতর্ক হলে ঘুড়িপ্রেমীরা নিজেরাই আঙুল কেটে আহত হতে পারেন। কিন্তু সে সব কথায় কান দিচ্ছে কে! দমদমের ঘুড়ি ব্যবসায়ী গোপাল সমাদ্দারের কথায়, ‘‘মানুষ তো এখন এই সুতোই চাইছে। বিক্রিও হচ্ছে হু হু করে।’’
পক্ষীপ্রেমীরা বলছেন, এই সুতো টেঁকসই হওয়ায় গাছের ডাল বা বিদ্যুতের খুঁটিতে জড়িয়ে থাকছে। বৃষ্টি-রোদে নষ্ট হচ্ছে না। দেখতে মিহি হওয়ার ফলে এর উপস্থিতি পাখিরা বুঝতেও পারছে না। তাই দিনে-রাতে উড়তে গিয়ে ডানা কেটে যাচ্ছে তাদের। পক্ষীবিশেষজ্ঞ সুমিত সেনের মতে, এই সুতোর ক্ষতিকারক দিক বোঝানোর জন্য মানুষকে সচেতন করা উচিত। দমদমে ইতিমধ্যেই সেই কাজ শুরু করেছেন দুলালবাবুরা।
চিনে মাঞ্জাসুতোর বিপদ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যালও। তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের কাছে এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি বন দফতরকে জানিয়েছি। আমরাও এ নিয়ে সচেতনতা প্রসারে নামব।’’ বন দফতরের এক কর্তার অবশ্য দাবি, পর্ষদ থেকে তাঁরা কোনও চিঠি পাননি। তবে এই সুতো নিয়ে ইতিমধ্যে খোঁজখবর শুরু করছেন তাঁরাও। পরিবেশকর্মীদের অনেকের অবশ্য দাবি, শুধু সচেতনতা প্রসার করলেই চলবে না। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো এ রাজ্যেও চিনে মাঞ্জাসুতো বিক্রি বন্ধ করা উচিত। এই দাবি মেনে ‘চিন’-কে ঠেকাতে রাজ্য শেষমেশ বাকি তিন মহানগরীর পথে চলে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy