ফ্রন্টের সভায় বিমান বসু ও অশোক ঘোষ।—ফাইল চিত্র।
এক বার ফোন করে খোঁজ নাও তো! এত ক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই! কপালিটোলা লেনের প্রায় বুজে যাওয়া ডোবার ধারে চারতলার ছোট্ট ঘরে অধৈর্য হয়ে পড়ছেন বৃদ্ধ!
যাঁর জন্য অপেক্ষা, তিনি নিজেও প্রৌঢ়ত্ব ছাপিয়ে ঢুকে পড়েছেন পরের অধ্যায়ে। নিজের মোবাইল নেই। কাজেই রাস্তাঘাটে থাকলে তাঁর খোঁজ রাখা মুশকিল। এ দিকে চারতলার ঘরে তাঁর জন্য উসখুস চলতেই থাকে নবতিপরের। কখন চৌকাঠে এসে দাঁড়াবেন অনুজপ্রতিম। হাতে এক পাত্র পায়েস! নিজের হাতে রেঁধে আনা। মুখে হাসি— ‘‘অশোকদা, রাগ হল নাকি!’’ তখন আর কোথায় রাগ? ফোকলা হাসি মুখে আদরের ‘বিমানবাবু’কে জড়িয়ে ধরবেন তাঁর ‘অশোকদা’।
দৃশ্যটা বছরের পর বছরের। তাঁর জন্মদিনে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সশরীর হাজির হয়ে শুভেচ্ছা না জানালে রাতে ঘুমই হবে না ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের! এমন অটুট বন্ধন চোখের সামনে দেখে পুলকিত হন দুই বাম দলের সদর দফতরের কর্মীরাও। বৃহস্পতিবার অশোকবাবুর ৯৪তম জন্মদিনেও যেমন হয়েছেন। তাঁরা বলেন, বিমানবাবু ওই দিনটায় কলকাতার বাইরে থাকলে তাঁর ‘অশোকদা’র জন্মদিনটাই যেন বিস্বাদ। আর থাকলে? পরমান্ন-সহযোগে সে জন্মদিন হয়ে ওঠে মধুর।
দু’জনেই পার্টির ‘হোলটাইমার’। পূর্বাশ্রমে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছেন। বহু বছর দু’জনেরই ঠিকানা নিজের নিজের দলের সদর দফতর। দু’জনেই অকৃতদার। এবং ঘটনাচক্রে দু’জনের জন্মদিন ক্যালেন্ডারের হিসেবে একেবারে অবিচ্ছিন্ন! বিমানবাবুর ১ জুলাই। ২ জুলাই অশোকবাবুর!
নিজের জন্মদিনের ঠিক পরের দিন বিমানবাবু যখন পায়েস হাতে আলিমুদ্দিন থেকে হেমন্ত বসু ভবনে আসেন, তখন তাঁর জন্য তৈরি থাকে অশোকবাবুর ‘রিটার্ন গিফ্ট’। সেটা কী? প্রবীণ নেতা সহাস্য বলছেন, ‘‘আমার জন্য সুগার-ফ্রি পায়েস নিজে রেঁধে আনেন বিমানবাবু। এক বার বলেছিলাম, খালি হাতে ফেরা চলবে না। ওঁর জন্মদিনের পায়েসটা তাই আমার এখানেই রান্না হয়। উনি সেটা পান পরের দিন। আমাকে পায়েস দেওয়ার সময়ে পাল্টাপাল্টি করে নিই!’’ প্রায় দু’দশক ধরে অশোকবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী যজ্ঞেশ্বর পাত্র (জগা) সযত্নে রাঁধেন বিমানবাবুর পায়েস।
স্নেহ-বন্ধুত্বের এই ইনিংসের গোড়াপত্তন কবে, ভাল মনে পড়ে না অশোকবাবুর। ঝাপসা হচ্ছে স্মৃতি। ৭৬-এ পা দেওয়া বিমানবাবু অবশ্য এখনও প্রখর। তাঁর বেশ মনে আছে, ১৯৮০ থেকে তিনি নিয়মিত অশোকবাবুর জন্মদিনে যান। অবশ্যই কলকাতায় থাকলে। বললেন, তাঁর এবং ‘অশোকদা’র বন্ধন আঁটোসাঁটো হয় পুরুলিয়া থেকে। সুইসার আশ্রমে তখন প্রায়ই থাকতেন অশোকবাবু। বিমানবাবুর কথায়, ‘‘আমি তখন পুরুলিয়ার দায়িত্বে। ওই জেলার লোকসভা আসনটা ফরওয়ার্ড ব্লক লড়ত, এখনও লড়ে। আমি সভায় বলতাম, চিত্ত মাহাতো শুধু ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী নন, সিপিএমেরও প্রার্থী। কথাটা অশোকদার পছন্দ হয়েছিল।’’
দল হিসেবে সিপিএম-ফরওয়ার্ড ব্লকের মধ্যে বিরোধ হয়েছে অনেক। কখনও রেগে আলিমুদ্দিন ছেড়ে চলে এসেছেন অশোকবাবু। কখনও চরমপত্র দিয়েছেন, ফ্রন্ট সরকার থেকে তাঁর মন্ত্রীদের তুলে নেবেন। কখনও আবার ফব-র প্রার্থ়ী পছন্দ না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন বিমানবাবু। অশোকবাবু রাগ করেছেন। কিন্তু প্রত্যেক বারই অগ্রজ নেতার কাছে গিয়ে মান ভাঙিয়েছেন বিমানবাবু। বাম সংসারে ভাঙন আসেনি।
কী করে হয়ে চলেছে এমন? রহস্য কি পায়েসেই? বিমানবাবু হেসে বলছেন, ‘‘মনে হয়, আমি অশোকদাকে বুঝি। আমি পড়ে নিতে পারি, উনি কী চাইছেন। সেই মতো কাজটা করি।’’ অশোকবাবুও মানছেন, বরফ গলাতে কত বার বিমানবাবু কুশলতা দেখিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই!
কিন্তু বয়সে প্রায় ১৮ বছরের অনুজ নেতাকে ‘বিমানবাবু’ কেন? সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বলছেন, ‘‘ওটা পুরনো অনেক লোকের স্টাইল। তবে তাতে কিছু এসে যায় না। আমিও এখন বুড়ো হয়েছি। কিন্তু অশোকদার কাছে ছোটই আছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy