বয়ান নিয়ে বিভ্রান্তি কাটার যেন লক্ষণ নেই! সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানার খুন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়েছিলেন পুলিশ সুপার। রবিবার সিসিটিভি ফুটেজের কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পরে সেই বয়ান কিছুটা বদলালেন তিনি।
বিভ্রান্তির সূত্রপাত ঘটনার দিন, অর্থাৎ শুক্রবার থেকেই। কৃষ্ণপ্রসাদের মৃত্যুর খবর শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়েছিল। ছাত্র পরিষদের ইউনিয়ন রুম লক করে ভিতরে সংঘর্ষ হয়। ব্যাটের আঘাতে মৃত্যু হয় ছাত্রের।’’ কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, টিএমসিপি কর্মীদের মারে কৃষ্ণপ্রসাদের মৃত্যু হয়। পুলিশ শুক্রবার রাতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর তিন জনকে গ্রেফতার করে। শনিবার আদালতে পেশ করে তাদের হেফাজতে নেয়। আদালতে সরকারি আইনজীবী জানান, সে দিন সবং কলেজে ছাত্র পরিষদ এবং টিএমসিপি-র মধ্যে অশান্তি হয়। অথচ শনিবার সন্ধ্যায় এসপি ভারতী ঘোষ সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেন, কলেজে একটা দলই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল এবং অভিযুক্তদের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়নি। মমতার ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন বলে পরিচিত ভারতীদেবী এ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ‘তত্ত্ব’কেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বলে সরব হন বিরোধীরা।
রবিবার সবংয়ের ওই কলেজের সিসিটিভি ফুটেজের কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় নিজের বক্তব্য থেকে পিছু হটেছেন ভারতীদেবী। শনিবার তিনি জানিয়েছিলেন, অভিযুক্ত ও ধৃতদের কাউকে (সকলেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের) ফুটেজে দেখা যায়নি। কিন্তু রবিবার প্রকাশিত ফুটেজে ধৃত শেখ মুন্নাকে দেখা যাওয়ার পরে তাঁর দাবি, ‘‘আমি বলেছিলাম লাঠি হাতে অভিযুক্তদের দেখা যায়নি।’’
এই ফুটেজের একাংশ প্রকাশ্যে আসার পরে বিরোধী দলগুলি পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছে। তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী ‘ছাত্র পরিষদের ইউনিয়ন রুম লক করে ভিতরে সংঘর্ষ এবং ব্যাটের আঘাতে ছাত্র মৃত্যুর’ যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ফুটেজে তার প্রমাণ মেলেনি। প্রতিটি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মারামারি হয় ইউনিয়ন রুমের বাইরে। অনেকের হাতে বাঁশের লাঠি থাকলেও কারও হাতে ব্যাট দেখা যায়নি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘কী ভাবে ছেলেটি মারা গেল, তার কিছু ফুটেজে বোঝানো যাচ্ছে না! অথচ এসপি সব দিক থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে নকল করার চেষ্টা করছেন!’’ সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কটাক্ষ, ‘‘এসপি-র কী করার আছে! তাঁর নেত্রী একটা তত্ত্ব দিয়েছেন। এখন ওঁকে মাথা নত করে তাই প্রতিষ্ঠা করতে হবে!’’
সিসিটিভি ফুটেজের কিছু অংশ… সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।
পুলিশি তদন্তের উপর আস্থা রাখতে পারছে না কৃষ্ণপ্রসাদের পরিবারও। নিহতের দাদা হরিপদ জানা বলেন, ‘‘মমতা ম্যাডামের কথামতোই জেলার এসপি কাজ করছেন। অভিযুক্তদের সিসিটিভিতে দেখা গেলেও পুলিশ তা চাপা দিতে চাইছে।’’ প্রয়োজনে তাঁরা পুলিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাবেন বলেও জানান হরিপদ। শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আশ্বাস, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাবে। তার আগেই বিরোধীদের চাপে ধৈর্য হারানো উচিত নয়।’’
কিন্তু পুলিশ সুপার বয়ান বদলালে পুলিশি তদন্তে আস্থা থাকবে কী করে, সে প্রশ্নও উঠছে। শনিবার ভারতীদেবী বলেন, “যে ছ’জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তাঁদের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়নি। ওই ছ’জনকে লাঠি হাতে দেখা যায়নি। ইনফ্যাক্ট একদমই দেখা যায়নি। যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদেরও দেখা যায়নি।” অথচ সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছে, খুনের ঘটনায় ধৃত তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর কলেজ শাখার সম্পাদক শেখ মুন্না মারামারির সময় উপস্থিত। এমনকী, একটা সময় নিহত ছাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ জানার সঙ্গে হাতাহাতি করতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। তবে মুন্নার হাতে লাঠি রয়েছে, এমন ছবি ধরা পড়েনি। যদিও এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, মারামারি চলাকালীন ছাত্র পরিষদের নেতা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র পল্টু ওঝার কাছ থেকে একটি বাঁশের লাঠি কাড়ার চেষ্টা করছেন মুন্না।
তা হলে কেন শনিবার পুলিশ সুপার বললেন অভিযুক্তদের কাউকে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়নি?
জবাব আনন্দবাজারকে দেননি ভারতীদেবী। ফোনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এসএমএস-এরও উত্তর দেননি। তবে একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে ভারতীদেবীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমি বলিনি, অভিযুক্তরা ওখানে ছিল না। বলেছি, অভিযুক্তদের হাতে লাঠি ছিল না।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘সিসিটিভি ফুটেজ কলেজের অধ্যক্ষ ও কর্মীদের সামনেই সিল করা হয়েছে। তাঁদের উপস্থিতিতেই দেখা হয়েছে সে দিন সবংয়ের কলেজে কী ঘটেছিল।’’
সিসিটিভি ফুটেজের আরও কিছু ছবিও কিন্তু পুলিশ সুপারের বয়ানের সঙ্গে মিলছে না। যেমন, শনিবার পুলিশ সুপার দাবি করেছিলেন, ‘‘কলেজের সিসিটিভি-র ফুটেজে দেখা যাচ্ছে একটি দলই দাপাচ্ছে।’’ এমনকী নিহত ছাত্রকে সেই দলের সঙ্গে মিশে হুমকি দিতে দেখা গিয়েছে বলেও দাবি ছিল তাঁর। এ দিন যদিও কলেজের ছাত্র সংদের ঘরের ভেতরে লাগানো ৪ নম্বর ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে, দফায় দফায় মারামারি হচ্ছিল ছাত্র পরিষদ ও টিএমসিপি-র মধ্যে। তার মধ্যে কৃষ্ণপ্রসাদকেও মারামারি করতে দেখা গিয়েছে। অন্য একটি ফুটেজে এসপি-র দাবি মতো, মারামারির সময় দেখা গিয়েছে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছাত্র পরিষদের সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়কেও। তাঁর হাতে লাঠি না থাকলেও ছাত্র পরিষদের অনেক সমর্থককেই লাঠি হাতে দেখা গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানসবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘বহিরাগতরা আক্রমণ করলে যে কোনও ছাত্র আত্মরক্ষা তো করবেই।”
কৃষ্ণপ্রসাদকে খুনের সময়কার কোনও ছবি ফুটেজে নেই। কেন খুনের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়ল না, তা স্পষ্ট নয়। কলেজ সূত্রের খবর, ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরার যা অবস্থান তাতে লাইব্রেরির সামনের যে মাঠে কৃষ্ণপ্রসাদকে পিটিয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ, সেই মাঠের একাংশের ছবি ধরা পড়ার কথা। একটি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে জখম কৃষ্ণপ্রসাদকে পাঁজাকোলা করে মাঠের দিক থেকে নিয়ে আসছে এক দল ছাত্র। তা হলে কেন খুনের মুহূর্ত ধরা পড়ল না, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া, কলেজের অধ্যক্ষ জানিয়েছিলেন সিসিটিভি রয়েছে ১৬টি। আর এসপি শনিবার দাবি করেন, ক্যামেরা আছে ১৫টি। তার একটি খারাপ। এই ফারাক কেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এই সব প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস বিধায়ক মানসবাবুর অভিযোগ, ‘‘সিসিটিভি-র ফুটেজের কিছু অংশ বেছে প্রকাশ করা হয়েছে। আহত ছাত্রটি যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার খোঁজ না নিয়ে সিসিটিভি-র ছবি কাটছাঁট করা হয়েছে। খুনিদের আড়াল করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার!’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও কটাক্ষ, ‘‘ওখানকার এসপি ‘হার মাস্টার্স ভয়েজ’-এ কথা বলেন! পুলিশ তো সম্পূর্ণ ফুটেজ দেখাচ্ছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy