Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
State News

বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত মানে শুধু বিরোধীদের হারানো নয়, দলের মধ্যের বিরোধিতাকেও চেপে দেওয়া

উন্নয়ন শব্দটি আজ এক ঘোরালো অর্থ নিলেও সেটা যে খানিকটা হয়েছে, তা গ্রামের দিকে খানিক গেলেই বোঝা যায়। প্রকল্প যারই হোক, অতি বড় নিন্দুকও দেখতে পাবেন সকলের উন্নতি, যে কোনও গাড়িওয়ালা— ছোট, বড়, মাঝারি অকুণ্ঠে এ কথা জানাবেন। আর বিদ্যুতের টানাটানি যে কমেছে, এ কথাও হলফ করে বলা যায়। নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন শিল্প নেই, তাই কিন্তু লোডশেডিং নিয়ে আর কোনও রচনা পরীক্ষায় আসে না।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ১৭:৫০
Share: Save:

পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যে হাড়কাঁপানো সন্ত্রাস চলল গ্রামবাংলায়, তার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গ্রামকে একটু নতুন করে চিনতে হবে বইকি। শহরে বসে যাঁরা ইকো-ট্যুরিজমের স্বপ্ন দেখেন এবং গ্রামে যান একবেলার ‘টাটকা’ স্বাদ নিতে, তাঁদের চোখে বিষয়টা রোমহর্ষক দক্ষিণী সিনেমার ট্রেলার হতে পারে, কিন্তু যাঁরা বসবাস করছেন তাঁদের জন্য এ এক কঠিন বাস্তব। গ্রামে থাকলে রাজনীতি খুব খারাপ বলে নাক কুঁচকে দিন কাটানো যায় না, সকলকেই অল্পবিস্তর এর আঁচ পোহাতে হয়। তাই আজ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যা মনে আসছে, তা এই— যাঁরা অপশাসন, দুঃশাসন থেকে উদ্ধার করার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা আজ এই রকম সন্ত্রাসের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠলেন কেন?

উন্নয়ন শব্দটি আজ এক ঘোরালো অর্থ নিলেও সেটা যে খানিকটা হয়েছে, তা গ্রামের দিকে খানিক গেলেই বোঝা যায়। প্রকল্প যারই হোক, অতি বড় নিন্দুকও দেখতে পাবেন সকলের উন্নতি, যে কোনও গাড়িওয়ালা— ছোট, বড়, মাঝারি অকুণ্ঠে এ কথা জানাবেন। আর বিদ্যুতের টানাটানি যে কমেছে, এ কথাও হলফ করে বলা যায়। নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন শিল্প নেই, তাই কিন্তু লোডশেডিং নিয়ে আর কোনও রচনা পরীক্ষায় আসে না।

উন্নয়ন থমকে আছে না থমকে দিয়েছে, সে প্রশ্ন মুলতুবি রেখেও সরকারি দফতর...বিদ্যালয়, সবেরই খানিক হাল ফিরেছে এটা দ্রষ্টব্য। অবশ্য সব কিছুতেই নীল-সাদা রং মানালো কি না, তা নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে।

যে রেশন ব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে গ্রামাঞ্চলে বিদ্রোহের সূচনা হয় গত সরকারের শেষবেলায়, যা ছিল শুরুতে স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্দলীয়— তারও উন্নতি ঘটেছে।

স্বজনপোষণের বদনাম সত্ত্বেও বলা যেতে পারে, এই ব্যবস্থার সুফল অনেক দূর পৌঁছেছে— যাঁরা চিরকাল যাবতীয় পরিষেবার বাইরে থাকতে অভ্যস্ত, সেই দরিদ্রতম, অশিক্ষিত, রাজনৈতিক অধিকারহীন মানুষের কাছে দু’টাকা কেজি দরে চাল পৌঁছেছে। জঙ্গলমহলের শান্তি কিন্তু এই পথেই।

আরও পড়ুন- সিপিএম পদ্ম আঁকছে, কটাক্ষ​

আরও পড়ুন- অপারেশন আলিপুর! শাসকের হয়ে ‘কাজ’ সারল যে দাগী আসামিরা​

কন্যাশ্রী প্রকল্প কতটা ফোলানো-ফাঁপানো তা নিয়ে হইচই চললেও এ কথা অনস্বীকার্য যে গ্রামাঞ্চলে স্কুলছাত্রীদের মধ্যে এ এক আশীর্বাদ স্বরূপ। প্রকল্পটি রূপায়ণে যে ভাবে সম্পূর্ণ সরকারি আমলাতন্ত্রকে নিয়োগ করা হয়েছে, সেই তৎপরতা আগের কালে খুব বেশি দেখা যায়নি। উপর থেকে নিচু পর্যন্ত এই নিয়ে এক তটস্থতা আছে, যার ফলে তালিকায় বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং প্রাপকের তালিকায় দু-একজন বিবাহিতাও ঢুকে যেতে পারেন। মেয়েরা স্কুলমুখী হয়েছে, স্কুলছুট কম হচ্ছে। টাকাটা পরবর্তীতে কী কাজে লাগছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সদর্থক ভাব বিনিময়ের পরিসর আজ সমস্ত স্তরে বিদ্যমান।

সবুজসাথী প্রকল্পেও এমনই সাড়া পড়েছে। নবম শ্রেণিতে উঠলেই সাইকেল পাওয়া যাবে, এ এক বহুকালের স্বপ্নপূরণ। উল্লেখ্য, তামিলনাড়ু বা বিহারে সাইকেল দেওয়ার যে প্রকল্প আছে তার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে প্রাপকের সংখ্যা যথেষ্টই বেশি।

এই সব প্রকল্পের কার্যকারিতা গ্রামাঞ্চলে সুদূরপ্রসারী। শহরের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এর কারণেই মূলত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বর্তমান সরকার যথেষ্টই সাড়া পেতেন। অবশ্য মহাত্মা গাঁধী নামাঙ্কিত প্রকল্পে দেশ জুড়ে যে লুঠতরাজ চলেছে, এখানেও তার কিছু ঘাটতি হয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিশেষ ভাবে রোজগারের ক্ষেত্রে যে দৈন্য, যার ফলে দলে দলে তরুণ ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে— সেখানে সুরাহা কিছু হয়নি।

সরকারি কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রামাঞ্চলে বহু শিক্ষিত বেকারের...উচ্চশিক্ষা লাভের পর চূড়ান্ত হতাশার জন্ম দিচ্ছে।

তা সত্ত্বেও এই সন্ত্রাসের প্রয়োজন কতটা ছিল, সেটাই প্রশ্ন। তা হলে কি শাসকের নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি আস্থা নেই? না কি অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভাগ-বাঁটোয়ারার লড়াই এমন আকার নিয়েছে যে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত শুধু বিরোধী দলকে হারানো নয়, দলের মধ্যেকার বিরোধিতাকেও চেপে দেওয়া। যে সাম্প্রদায়িক শক্তির দোহাই দিয়ে এই আস্ফালন, তাকে প্রতিহত করতে পাল্টা সাম্প্রদায়িকতা ইতিমধ্যেই জনমানসে বিভেদের সৃষ্টি করেছে। শাসকদলের কাছে তা কাম্য ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা না রেখে স্থূল ধর্মাচরণের প্রতিযোগিতা গোটা সমাজকে অসুস্থ করে তুলেছে। তার উপর এই ভয় দেখিয়ে চুপ করানো, গণতন্ত্রবিরোধী একনায়কতন্ত্রের পথই তৈরি করে দিল। আগামী দিনে তার খেসারত দিতেই হবে। যাবতীয় সুশাসন ও পরিষেবার উপর স্টিম রোলার চালিয়ে এল সন্ত্রাস। মাঠে না নেমেই জয় চাই। হিংসা শুধু হিংসারই জন্ম দিতে পারে। তাই আজ যা ভোটের হিংসা, কাল তা প্রতি দিনের হিংসায় পরিণত হবে। যে হাতে অস্ত্র উঠে এল, সে এখন কোথায় কোপ দেবে, কেউ জানে না। কথায় কথায় গা-জোয়ারি আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

এটুকু বলা যেতেই পারে, যাঁদের উপর কেউ আস্থা রাখলেন না, যাঁদের মতামতের সামনে দাঁড়ানোর সাহস কারও হল না, যাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের পথ বন্ধ করে দেওয়া হল— সেই জনগণ আজ চুপ থাকলেও ইতিহাস বলছে, এ দেশে বার বার গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে এঁরাই ধাক্কা দিয়েছেন, আবার নতুন পথ তৈরি হয়েছে।

ভরসা রাখতেই হবে গ্রামাঞ্চলের সেই বিপুল জনগোষ্ঠীর উপর যাঁরা নাগরিক কর্তব্য মনে করেই ভোট দিতে আসেন এবং ভোট দিতে চাইছেন।

(লেখক বীরভূমের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Panchayat Election 2018 TMC Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE