মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কোনও অবস্থাতেই জমি অধিগ্রহণ করবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন অনমনীয় অবস্থানের জেরে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে সেনাবাহিনীকেও আপস করতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় জমির অভাবে উত্তরবঙ্গে থমকে গিয়েছে তিনটি ফৌজি ঘাঁটি নির্মাণ-সম্প্রসারণের পরিকল্পনা। চিনের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যেগুলো অবিলম্বে কার্যকর করে তোলা খুবই জরুরি ছিল বলে সেনা-কর্তাদের অভিমত।
সমাধান-সূত্রের খোঁজে মাস দেড়েক আগে দু’পক্ষ মুখোমুখি বসেছিল। কিন্তু সুরাহা অধরা রয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতিনিধি ও নবান্ন-কর্তাদের মধ্যে আয়েজিত ওই ‘সিভিল-মিলিটারি লিয়াজঁ’ বৈঠকে সেনা-আধিকারিকেরা জানিয়েছিলেন, প্রস্তাব পেশের তিন বছর বাদেও রাজ্য প্রশাসন উচ্চবাচ্য করেনি। অথচ এখনই জমি হাতে না-পেলে জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি থেকে যাবে। নবান্নের খবর, এমন আশঙ্কাবাণী শোনার পরও জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে রাজ্যের তরফে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি।
পরিণামে সম্ভাব্য বিদেশি আগ্রাসন প্রতিরোধের উদ্যোগও দস্তুরমতো হোঁচট খাচ্ছে। কী রকম?
সেনা-সূত্রের খবর, দক্ষিণ তিব্বত সীমান্তে চিনের সামরিক প্রস্তুতির ছবিটা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক পূর্বাঞ্চলে প্রথম মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাকে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মোতায়েন রাখার কথা। কেন্দ্রে পূর্বতন ইউপিএ জমানার শেষ পর্বে, এ কে অ্যান্টনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন এতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন মিলেছে। বাহিনী গঠনের খরচ ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পূর্বাঞ্চলীয় মাউন্টেন স্ট্রাইক কোরের অধীনে দু’টি মাউন্টেন ডিভিশন ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে একটা নাগাল্যান্ডের রঙ্গাপাহাড়ে, অন্যটা তেজপুরের কাছে মিশামারিতে।
এবং গোটা উদ্যোগটির সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ। পূর্বাঞ্চলীয় মাউন্টেন স্ট্রাইক কোরের সদর দফতর হয়েছে এ রাজ্যের পানাগড় সেনা ছাউনি। শুধু তা-ই নয়, সিকিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরিকাঠামো বাড়ানোর লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গে তিনটি সেনা ঘাঁটি তৈরির কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু তারই জন্য প্রয়োজনীয় জমি মিলছে না। এক পদস্থ সেনা-আধিকারিকের আক্ষেপ, “যা পরিকল্পনা, তাতে পশ্চিমবঙ্গে ওই তিনটে ঘাঁটি অত্যন্ত জরুরি। রাজ্য সরকার জমি দিতে না-পারায় আমরা থমকে গিয়েছি। কার্যত উদ্যোগটির সাফল্যই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।”
প্রস্তাবিত তিনটি ঘাঁটির মধ্যে জলপাইগুড়ির ডামডিম ও শওগাঁওয়ে দু’টি নতুন ঘাঁটি তৈরির কথা। সঙ্গে কালিম্পঙে বর্তমান সেনা ছাউনির সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। নবান্ন-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ফৌজি-প্রতিনিধিরা জানান, নতুন বাহিনী মোতায়েন ও আধুনিক সরঞ্জাম মজুত করতে ডামডিমে ৭৫০ একর জমি প্রয়োজন। সেনা ও প্রশাসন রেল স্টেশন থেকে ডামডিম পর্যন্ত জমি চিহ্নিত করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রক অধিগ্রহণের সবুজ সঙ্কেত দেয় ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে। অথচ তা চূড়ান্ত করতে রাজ্যের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট দরকার, দরবার করেও তা মিলছে না বলে সেনা-কর্তাদের অভিযোগ।
স্বভাবতই ডামডিমে নতুন ঘাঁটির কাজ এগোয়নি। অন্য দু’জায়গাতেও একই অবস্থা। শিলিগুড়ি করিডরের শওগাঁওয়ে ৩৬১ একর জমিতে বায়ুসেনার ‘কম্পোজিট অ্যাভিয়েশন বেস’ (সিএবি) তৈরির পরিকল্পনা ফেঁঁসে রয়েছে জমি-জটে। নবান্নের সঙ্গে বৈঠকে সেনা-কর্তারা জানান, জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে শিলিগুড়ি করিডরে কিছু উন্নতমানের অস্ত্র মজুত রাখা জরুরি। তাই সিএবি গড়ার ভাবনা। এ জাতীয় ঘাঁটি থেকে জঙ্গিবিমান যেমন অভিযান চালাতে পারে, তেমন সেনাবাহিনীরও বড়সড় উপস্থিতি থাকে। এ দিকে শওগাঁওয়ে চিহ্নিত ৩৬১ একরের মধ্যে রয়েছে ২২৮ একরের একটি চা-বাগান, যার ৯৭ একর সেনার হাতে। বাগানের বাইরে ৯৮ একর রাজ্যের হাতে। বাকি ১৬৬ একর অধিগ্রহণের জন্য রাজ্যকে বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি বলে ফৌজি-প্রতিনিধিরা বৈঠকে অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছেন।
কালিম্পঙের সেনা-ছাউনি সম্প্রসারণেও বাদ সেধেছে জমি। সেনা-সূত্রের দাবি: সিকিমের তিব্বত-সীমান্তে ফৌজি নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হল কালিম্পঙের সেনা-ঘাঁটি। আপাতত সেখানকার ৪১৫ একরের ছাউনিতে প্রায় ১৩ হাজার সেনা মোতায়েন। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এটিকে আড়ে-বহরে তিনগুণ বাড়াতে চায়। যে জন্য কালিম্পঙের দূরবিনডারা এলাকায় ১২৫০ একর জমি রাজ্যের কাছে চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩৩ একর রাজ্যকে অধিগ্রহণ করে দিতে হবে। কিন্তু কালিম্পংয়ের মহকুমা ভূমি-আধিকারিক সেনা-কর্তৃপক্ষকে জানান, অধিগ্রহণের ব্যাপারে রাজ্য সরকার কোনও সিদ্ধান্ত না-নেওয়ায় জমি জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না।
এমতাবস্থায় সেনা-কর্তারা রাজ্য সরকারকে ফের অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে ওই জমি দ্রুত অধিগ্রহণ হয়। “দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে কালিম্পং মিলিটারি স্টেশনের আয়তন না-বাড়িয়ে উপায় নেই।” বলছেন ফোর্ট উইলিয়ামের এক আধিকারিক। অনুরোধের জবাব অবশ্য এখনও আসেনি। প্রশাসনের কী বক্তব্য?
বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেও নবান্নের কর্তারা যে কার্যত অসহায়, তা স্পষ্ট। সিভিল-মিলিটারি লিয়াজঁ বৈঠকে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, এমন এক আমলা বলেন, “সেনাবাহিনী বা বায়ুসেনার প্রস্তাবের গুরুত্ব আমরা বুঝি। তবু কিছু করার নেই। ওঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণের নীতি থেকে সরে এসেছে।”
রাজ্যের এই মনোভাবে সেনা-কর্তৃপক্ষ হতাশ। তাঁদের মতে, উত্তর-পূর্ব সীমান্তে সমরসজ্জার সার্বিক উদ্যোগে বলতে গেলে চোনা ফেলেছে জমি-সমস্যা। সেনা সূত্রে খবর, অসমের তেজপুর ও ছাবুয়ায় সুখোই বিমানের ঘাঁটি বানানো হয়েছে। যোরহাট, বাগডোগড়া, হাসিমারা ও মোহনবাড়ি বিমানঘাঁটির আধুনিকীকরণ চলছে। পানাগড়ে মাউন্টেন কোরের সদরে নতুন ঘাঁটি হয়েছে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমানের, যা কিনা খুব অল্প সময়ে সীমান্তে সেনা ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে সক্ষম। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে উত্তরবঙ্গের তিনটি ঘাঁটির ভূমিকা হবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু রাজ্য সরকারের জমি-নীতির জেরে সবটাই ঢাকা পড়েছে ঘোর সংশয়ের ছায়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy