রায় ঘোষণার পরে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন মৌসুমী। —নিজস্ব চিত্র।
দু’জনে একে অন্যকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। বলছেন, ‘‘দিদি দেখলেন তো, সব ঘটনা সাজানো নয়। ছোটও নয়। মেয়েরা নিরাপদ নয়। তাদের দিকে একটু নজর দিন।’’
যাঁর উদ্দেশে এই আর্জি, তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল গ্রামের পথে, বছর আড়াই আগে। কামদুনির কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করেছে এক দল লোক। এই ঘটনার দশ দিন পরে ওই গ্রামে গিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিহত ছাত্রীর সারা শরীরে নৃশংসতার চিহ্ন দেখে শোকে ভেঙে পড়েছিলেন তাঁর বন্ধু মৌসুমী কয়াল ও টুম্পা কয়াল। মুখ্যমন্ত্রী কামদুনিতে গেলে বন্ধুর খুনের বিচার চাইতে মমতার কনভয়ের সঙ্গে প্রায় দু’কিলোমিটার ছুটেছিলেন তাঁরা। বিনিময়ে জুটেছিল ‘মাওবাদী’ তকমা। শনিবার কামদুনি-কাণ্ডে রায় ঘোষণার পরে কান্নায় বুজে আসা গলায় সেই মৌসুমী-টুম্পাই
বলছিলেন, ‘‘দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয়, সে কথা বলতেই ওই দিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম।’’ তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতি করতেও যাইনি। ভেবেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী তো মহিলা। তাই যন্ত্রণাটা বুঝবেন।’’ কিন্তু সে দিন টুম্পাদের কথা কানে তোলেননি মমতা। ‘‘শনিবার এত দিন পরে ওঁর (মুখ্যমন্ত্রী) হয়তো অনুশোচনা হচ্ছে’’— বলছেন কামদুনির দুই মেয়ে।
ওই ঘটনার পরে মমতার উপরে অভিমান ঝরে পড়েছিল মৌসুমীদের। পরবর্তী কালে সেই অভিমান সম্বল করেই কামদুনি থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। মিছিল করেছেন কলকাতার রাজপথে। দিনের পর দিন মামলার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন আদালতের বাইরে। এ দিন ছয় অভিযুক্তের সাজা ঘোষণার পরে মৌসুমী আর টুম্পা বলছেন, ‘‘সে দিন দিদি যা-ই বলুন না কেন, মনে মনে হয়তো তিনিও চেয়েছিলেন, এমন নৃশংস অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। তাই সরকারি আইনজীবীর কাছ থেকে সহযোগিতা মিলেছে। সরকারকে ধন্যবাদ, দিদি-কেও।’’
এই ক’দিন কার্যত চোখে ঘুম ছিল না ওঁদের। এক দিকে রায় নিয়ে দুশ্চিন্তা, অন্য দিকে দিনভর তাঁদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাড়াকাড়ি। এ দিনও ভোরের আলো ফোটার আগেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন দু’জনে। সঙ্গে কামদুনি স্কুলের প্রাক্তন মাস্টারমশাই, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। দুপুরে টেলিভিশন চ্যানেলে বসে কথা বলার ফাঁকেই রায় ঘোষণা করলেন বিচারক। শুনেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন মৌসুমী আর টুম্পা।
এ কান্না আনন্দের। লড়াই জয়ের। আবার বন্ধু হারানো কষ্টেরও। ‘‘এই আড়াই বছরে কত যে শ্লেষ-অপবাদ সইতে হয়েছে! আমরা নাকি টাকা নিয়ে এ সব করছি! টিভিতে মুখ দেখাচ্ছি। এমনকী, কচুকাটা করবে হুমকি-ফোনও এসেছে বাড়িতে,’’— বলছিলেন দু’জনেই। বলছিলেন এত কিছুর পরেও দাঁতে দাঁত চেপে জোট বেঁধে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার কথা। বলছিলেন, ‘‘সরকারের দেওয়া চাকরি নিয়ে আন্দোলন ছেড়ে চলে যাইনি।’’ তার পর থেকে এ দিনের শাস্তিদান পর্যন্ত বাকিটা ইতিহাস। টুম্পাদের কথায়, ‘‘আজ আর দুঃখ নেই। মেয়ে হিসেবে মনে হচ্ছে, আজ জীবন ধন্য।’’
কথার ফাঁকেই মৌসুমীর মোবাইলে ফোন এল। হেসে বললেন, ‘‘বাবা, জিতে গিয়েছি। তোমরা খুশি তো?’’ সেই ফোন ছেড়ে ফের শুরু হল কথা। বললেন, ‘‘আমার বাবা স্বপন মণ্ডল তৃণমূলের সমর্থক। প্রতিবাদ আন্দোলনের একেবারে গোড়ায় এ সবের মধ্যে ঢুকতে বারণ করেছিলেন।’’ এতে অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্রী নন মৌসুমী। পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন বাবাকে, ‘‘আমার সঙ্গে এমন হলে কী করতে?’’ এর পরে আর বাধা দেননি স্বপনবাবু। এ দিন সেই বাবা-ই টেলিফোনে উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘‘যদি দেশের ভাল কাজে মেয়ের জান যায়, তাতেও দুঃখ নেই। আমার, মেয়েরও একই কথা।’’
পরিবারকে এ ভাবে পাশে না পেলে এত দিন মাটি আঁকড়ে আন্দোলন
করা সম্ভব হত না— বলছিলেন দুই প্রতিবাদী। আবেগে কখনও হেসে, কখনও কেঁদে বলছিলেন, এর পরেও অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করবেনই। কারণ, সেই অভ্যাস ওঁদের মজ্জাগত। শুধু কামদুনি নয়, তার বাইরেও।
টুম্পা-মৌসুমীর আশঙ্কা, সাজাপ্রাপ্তদের সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রতিবাদের শোধ তুলতে তাঁদের উপরে হামলা করতে পারে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে দু’জনের অনুরোধ, ‘‘আমাদের গ্রামের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন দিদি। নিজেরা ভয় পাই না। কিন্তু আমাদের সংসার রয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা রয়েছে। তাই আপনার উপরেই আমাদের ভরসা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy