Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

এ বার মনে হয় আমার মাথাটাও খারাপ হবে

২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর চড়াবিদ্যা পঞ্চায়েতের তিন নম্বর হেতালখালির ঘটনা।

রিয়াজুলের ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা। ছবি: সামসুল হুদা

রিয়াজুলের ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা। ছবি: সামসুল হুদা

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০৩:৩৮
Share: Save:

গুলির শব্দ শুনে সে দিন ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে হাত ধরে পালাচ্ছিলেন মা। আচমকা গুলি লাগে ছেলে রিয়াজুলের বুকে। মায়ের হাত ছাড়িয়ে পড়ে যায় ছেলে। রক্তে ভেসে যায় মায়ের কোল। বাঁচানো যায়নি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রিয়াজুলকে। সেই শোকে কেঁদে কেঁদে দিনরাত এক করেছেন সারুকা বিবি। এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। পরিবারটাই কার্যত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে।

২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর চড়াবিদ্যা পঞ্চায়েতের তিন নম্বর হেতালখালির ঘটনা। সে দিনের কথা উঠতেই কেঁদে ফেললেন রিয়াজুলের ঠাকুরদা, সত্তর ছুঁইছুঁই আবু লস্কর মোল্লা। জানালেন, ওই ঘটনার পরে ছেলে-বৌমা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। স্ত্রী আলেকজানকে পাশে বসিয়ে বৃদ্ধের বিলাপ, ‘‘আমাদের এখন আর দেখার কেউ নেই গো!’’ কেন বাড়ি ছাড়লেন রিয়াজুলের বাবা-মা? বৃদ্ধের ব্যাখ্যা, মরা ছেলের স্মৃতি ভুলতেই অন্যত্র থাকেন তাঁরা।

কী হয়েছিল সে দিন? গ্রামের লোকের কাছে এখনও সে দিনের স্মৃতি টাটকা। অনেকেই জানালেন, শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর গুলির লড়াই শুরু হয়েছিল। তারই মাঝে পড়ে প্রাণ হারায় ন’বছরের রিয়াজুল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গোটা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনায় মূল চক্রী হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা তপু মাহাতো। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এলাকার জমি দখল নিয়ে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর গুলির লড়াই বেধেছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। গ্রামবাসীদের হিসাবে, কয়েকশো রাউন্ড গুলি চলেছিল সে দিন। রিয়াজুলের মৃত্যুর পরে চড়াবিদ্যার হেতালখালিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। শাসক দলের এক গোষ্ঠী নির্বাচনের দিন বোমাবাজি করে বুথের দখল নিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ভোটের পরে তপুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি এখন জামিনে মুক্ত। তবে প্রধান শিক্ষকের চাকরিটা গিয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানালেন, তপু-সহ প্রায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অধিকাংশই জামিনে মুক্ত।

রিয়াজুলের ঠাকুমা বলেন, ‘‘ছেলেঅন্ত প্রাণ ছিল ওর মায়ের। সারা দিন ছেলেকে নিয়েই থাকত। কোনও সময়ে ছেলেকে নিজের কাছছাড়া করত না।’’ আলেকজান জানান, ছেলে মারা যাওয়ার পরে বেশ কয়েক দিন মুখে খাবারটুকু তোলেননি বৌমা। সপ্তাহখানেক পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের পরামর্শে স্বামী রফিকুল সারুকাকে নিয়ে বাড়়ি ছেড়ে চলে যান। আর ফেরেননি। আলেকজানের আক্ষেপ, ‘‘একবার গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। বৌমা চিনতেই পারল না। ছেলে বলেছিল, তোমার নাতির মৃত্যুর পরে বৌমার মাথার ঠিক নেই।’’

আলেকজান জানান, রফিকুলরা চলে যাওয়ার পরে তাঁরাও পড়েছেন অথৈ জলে। এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। বিয়ের কিছু দিন পর থেকে তিনি বাপের বাড়িতেই থাকেন। তাঁর ভিক্ষের টাকায় দু’বেলা দু’টো চালে-ডালে জুটে যায়।

কুমড়োখালি গ্রামে গিয়ে দেখা হল রিয়াজুলের বাবা পেশায় দিনমজুর রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। জানালেন, স্ত্রীকে সুস্থ করা জন্য ডাক্তার-বদ্যি ঢের করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনরাত স্ত্রী বিড়বিড় করে রিয়াজ-রিয়াজ করে। ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। ঘুম ভাঙলেই মুখে রিয়াজ আর রিয়াজ।’’

মাটির বাড়ির বারান্দায় বসে রফিকুল বলেন, ‘‘আমার এখন ঘোর বিপদ। স্ত্রীকে সুস্থ করতে বাড়ি ছেড়েছি। তেমন আয় নেই। বৃদ্ধ বাবা-মাকেও দেখতে পারি না। চিকিৎসকেরা সারুকাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন। আমি আর কত দিক দেখব! এ বার মনে হয় আমারও মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Basanti West Bengal TMC TMC Clash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE