কাটোয়া হাসপাতালে দুই ছেলেকে নিয়ে বসে রয়েছেন নূরবানু বিবি। পাশে, ভেঙে পড়া বাড়িটি। —নিজস্ব চিত্র।
দুর্যোগের আবহাওয়ায় নতুন বাড়ি পাহারা দিতে একসঙ্গে গিয়েছিলেন দু’ভাই। রাতে পড়শি আর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন তাঁরা। ভোর হওয়ার আগে হুড়মুড়িয়ে বাড়ির অ্যাসবেস্টসের চাল ও দেওয়ালের একাংশ পড়ে মারা গেলেন দু’জনেই।
পুলিশ জানিয়েছে, কাটোয়ার অজুর্নডিহি গ্রামের বাসিন্দা ওই দুই ভাইয়ের নাম রওসন মল্লিক (২৮) ও আজগর মল্লিক (১৫)। রবিবার দুপুরে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে বিকেলে গ্রামেই শেষকৃত্য হয় তাঁদের। হাজির হয়েছিলেন কাটোয়া ১ ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরাও।
অর্জুনডিহি গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় একটি বাড়ি ছিলই থেকে রওসন। আজগরের বাবা নজরুল মল্লিকের। তবে সম্প্রতি কিছুটা দূরে মাটির দোতলা আর একটি বাড়ি বানান তিনি। চার ঘরের বাড়িটির কাঠামো তৈরি হয়ে গেলেও দরজা-জানলা লাগানো হয়নি এখনও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খেতজমির ধারে ওই বাড়িতে বাইরের লোকজনের উৎপাত ঠেকাতে প্রতিদিনই দু’ভাই শুতে যেতেন। শনিবারও নতুন বাড়ির দোতলার একটি ঘরে শুয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পড়শি যুবক সইফুদ্দিন মল্লিকও। এ দিন দুর্ঘটনার পরে তিনিই কোনও রকমে বাইরে বেরিয়ে এসে গ্রামের সবাইকে খবর দেন। তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়েই মসজিদের মাইকে দুর্ঘটনার কথা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা শুনে ভোরের আলো ফোটার আগেই গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় ছুটে আসেন গ্রামবাসীরা। বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হয় উদ্ধার কাজ। সকালে দেওয়াল ও ভাঙা অ্যাসবেস্টসের চালের ফাঁক থেকে উদ্ধার করা দুই ভাইয়ের দেহ। পুলিশ এসে মৃতদেহ দুটিকে ময়না-তদন্তের জন্য কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সইফুদ্দিন মল্লিক পুলিশকে বলেন, “তখন রাত তিনটে হবে। হঠাৎ ঘরের চালের একটি কাঠ খুলে পড়ে। আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। উঠে দাঁড়াতেই বাড়িটা কেমন দুলে ওঠে। অবস্থা ভাল নয় বুঝে ওদের দুই ভাইকে ঘুম থেকে তুলে আমি ছুটে বাড়ির বাইরে চলে আসি। মুহূর্তে চোখের সামনে বাড়িটা ভেঙে পড়ে। ছুটে গিয়ে গ্রামে খবর দিই।”
নজরুলবাবুর চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে নওসদ গ্রামেই পৃথক থাকেন। মেজ রওসন এবং সেজ আজগর বাড়িতে বাবার সঙ্গে থাকেন। আর ছোট ছেলে বালক মোল্লা সম্প্রতি কেরলে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে গিয়েছেন। বিবাহিত রওসনের চার ও দু’বছরের দুটি ছেলেও রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই পরিবারের পাঁচ বিঘার মতো জমি রয়েছে। তবে টানা বৃষ্টি আর নদী-নালা উপচে আসা জলে সে জমি এখন জলের তলায়। সংসার চালানোর জন্য নজরুলবাবু ও তাঁর ছেলেরা দিনমজুরের কাজ করেন। রবিবার কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে নজরুলবাবু বলেন, “আমাদের অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। তা না হলে নাবালক ছেলেদের উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। তার মধ্যে তো আবার একজন আমাদের ছেড়ে চলে গেল।” তিনিই জানান, চার ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনিদের নিয়ে আর পুরনো বাড়িতে ধরছিল না বলে নতুন বাড়ি তৈরি করা হচ্ছিল। কিন্তু সব যে এভাবে চলে যাবে ভাবা যায়নি। রওসনের স্ত্রী নূরবানুবিবি দুই ছেলেকে নিয়ে বাপেরবাড়ি ভাতারের ভাটাকুল গ্রামে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে আসেন তিনি। নূরবানুবিবি বলেন, “এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না! কোলের ছেলেদের নিয়ে কী করে সংসার চালাব বুঝতে পারছি না।”
গ্রামের বাসিন্দাদের ধারণা, গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টির জন্য নতুন মাটির বাড়িটির ভিত আলগা হয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই গভীর রাতে বাড়িটি ধসে পড়ে। কাটোয়া ১ যুগ্ম বিডিও সুবীর দন্ডপাটের আশ্বাস, “প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy