Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বন্ধ ঘরে ট্রলি, কোলে যাতায়াত রোগীদের

দৃশ্য ১: জ্যৈষ্ঠের রোদ মাথায় নিয়ে, হাতে স্যালাইনের বোতল ধরে রাধারানি ওয়ার্ড থেকে আলট্রাসোনোগ্রাফির ঘরের দিকে এক বৃদ্ধাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পরিজনেরা। দৃশ্য ২: জরুরি বিভাগে কোমরে আঘাত নিয়ে ভর্তি রয়েছেন এক প্রৌঢ়া। দোতলা থেকে তাঁকে কোলে করে নিচে নিয়ে এক্স-রে করাতে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির লোকেরা। দৃশ্য ৩: জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচারের ঘর থেকে পাঁজাকোলা করে ওয়ার্ডে নিয়ে ‌আসা হচ্ছে পা ভাঙা এক রোগিনীকে।

কোলে করে বর্ধমান মেডিক্যালের সিঁড়ি দিয়ে নামানো হচ্ছে রোগীকে।

কোলে করে বর্ধমান মেডিক্যালের সিঁড়ি দিয়ে নামানো হচ্ছে রোগীকে।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০০:৪৫
Share: Save:

দৃশ্য ১: জ্যৈষ্ঠের রোদ মাথায় নিয়ে, হাতে স্যালাইনের বোতল ধরে রাধারানি ওয়ার্ড থেকে আলট্রাসোনোগ্রাফির ঘরের দিকে এক বৃদ্ধাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পরিজনেরা।

দৃশ্য ২: জরুরি বিভাগে কোমরে আঘাত নিয়ে ভর্তি রয়েছেন এক প্রৌঢ়া। দোতলা থেকে তাঁকে কোলে করে নিচে নিয়ে এক্স-রে করাতে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির লোকেরা।

দৃশ্য ৩: জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচারের ঘর থেকে পাঁজাকোলা করে ওয়ার্ডে নিয়ে ‌আসা হচ্ছে পা ভাঙা এক রোগিনীকে।

দৃশ্য তিনটি আলাদা হলেও একটি জায়গায় মিল রয়েছে। তিন বাড়ির লোকেরাই তাঁদের রোগীকে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে একটা ট্রলি খুঁজছেন। কিন্তু ট্রলি দেবে কে? চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের দেখা মেলা ভার। যদিও বা পাওয়া যায়, ট্রলির কথা বললেই জবাব আসে, “স্টোর থেকে বের করে দেব, আবার নিয়েও যাব। তার জন্য কিছু তো দিতে হবে।” এই ‘দেওয়ার’ পরিমাণ ২০ থেকে ৫০ টাকা। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী যাতায়াতের ট্রলি দেওয়া নিয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ঘুষ নেওয়ার প্রবণতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো কতটা বেহাল। রোগীদের অভিযোগ, এমনিতেই জরুরি বিভাগে শয্যা পাওয়া খুবই কঠিন, তার উপর এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য ট্রলি পাওয়া মানে ‘হাতে চাঁদ পাওয়া’।

হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও ছেলে ভিক্টর পাঁজাকোলা করে জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচারের ঘর থেকে বারান্দায় রাখা একটি শয্যায় মাকে নামিয়েছেন। কোথাও মেমারির কেন্না গ্রামের লক্ষ্মী সোরেনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ট্রলি খুঁজছেন তাঁর ছেলে। বীরভূমের রামপার থানার চাকপাড়া গ্রামের ছবি সূত্রধরও গত কয়েকদিন ধরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শয্যায় শুয়ে তিনি বলেন, “১৫ দিন হয়ে গেল এখানে রয়েছি। ছেলের কোলে করেই উপর-নীচ করছি। একটা ট্রলিও জোটেনি।” গলসি থেকে এক বৃদ্ধা পড়শিকে নিয়ে জরুরি বিভাগে এসেছিলেন শঙ্করী সাহা। ওই বৃদ্ধা বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড়ে চিড় ধরেছে। তাঁকে আনা হয়েছিল একটি অ্যাম্বুল্যান্সে শুইয়ে। কিন্তু অ্যম্বুল্যান্স-চালক হাসপাতালে ঢোকার পরেই জানিয়ে দেন, অ্যাম্বুল্যান্সের ট্রলি ভিতরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অগত্যা জরুরি বিভাগের সামনে ছোটাছুটি শুরু হয় শঙ্করীদেবীর। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পেয়েছি ‘টিকিট কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করুন’। সেখানে জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়েছে, ‘জিডিএ (চতুর্থ শ্রেণির কর্মী)দের কাছে যান’। আর জিডিএ-রা বলেছেন, ‘একটাই মাত্র ট্রলি। উপর-নীচ করছে। দাঁড়াতে হবে’।’’ তাঁর দাবি, ওই বৃদ্ধা রাস্তায় বসে কষ্ট পাচ্ছেন দেখেও কেউ এগিয়ে আসেনি। শঙ্করীদেবী বলেন, “৫০ টাকা চেয়েছিল। তিরিশ টাকা দেব বলতেই দোতলা থেকে ট্রলি চলে এল। জিডিএ কর্মীরাই দোতলায় নিয়ে যেতে আমাকে সাহায্য করলেন।”

হাসপাতালে ঘরেই পড়ে একাধিক ট্রলি।

হাসপাতালে আসা-যাওয়ায় অনেকেই টাকার বিনিময়ে ট্রলি পাওয়ার পদ্ধতি জেনে গিয়েছেন। মেমারির শ্যামলাল দত্ত কিংবা রায়নার সান্ত্বনা সরকারে যেমন বলেন, ‘‘আমরা ঘাতঘোঁত জেনেই এখানে এসেছিলাম। তাই ট্রলি পেতে আমাদের অসুবিধা হয়নি।” আর যাঁরা এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন তাঁরা পাঁজাকোলা করেই রোগীকে নিয়ে যাওয়াআসা করেন। মেমারির দেবীপুরের বেবী স্বর্ণকার যেমন বলেন, “হাপাতালে এসে শয্যা মেলেনি। মাটিতে শুয়ে রয়েছি। এই ক’দিনে একবারের জন্যও ট্রলি পাইনি। একতলায় ইউএসজি করার জন্য আমাকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করছে বাড়ির লোকেরা।’’ একই অভিজ্ঞতা বীরভূমের লোকপুর থানার ভাদুলিয়া গ্রামের আভারানি রুইদাসের। তাঁর কথায়, “কার কাছে গেলে ট্রলি মিলবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। অথচ আমাদের বারান্দার পাশে একটা বন্ধ ঘরে ট্রলি রাখা রয়েছে বলে শুনছি।”

হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে থাকা বেশ কয়েকজন সিভিক ভলেন্টিয়ারও তাঁদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় এমনটা বারবার দেখতে পান। জরুরি বিভাগের সামনে বসে তাঁদের মধ্যেই এক জন বলেন, “কোনও দিন দুর্ঘটনার সময় হাসপাতালে এলে বুঝতে পারবেন রোগীরা কতটা অসহায়। একটা ট্রলির জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। অথচ ট্রলিগুলো জরুরি বিভাগের দোতলায় কিংবা পুলিশ ক্যাম্পের পাশের ঘরে জড়ো হয়ে পড়ে থাকে।’’ তাঁরাই জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে শক্তিগড়ে পথ দুর্ঘটনায় জখম তিন মহিলাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে জরুরি বিভাগের দোতলায় ভর্তি করানো হয়েছে। আর এক সিভিক ভলেন্টিয়ার বলেন, “ট্রলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকা রোগীর পরিজনদের কাছ থেকে আমাদের চোখের সামনে টাকা নেয় হাসপাতালের কর্মীরা।” এই ট্রলির জন্যই যে কোনও দিন হাসপাতালে গোলমাল লাগতে পারে বলে আশঙ্কা বর্ধমান পুলিশেরও। তবে হাসপাতালের ভিতরে থাকা ক্যাম্পের পুলিশেরা সতর্ক থাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে তাঁদের দাবি।

বর্ধমান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বিলক্ষণ জানেন, ট্রলির সমস্যার কথা। ট্রলির অভাবে রোগীদের এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে বা এক্স-রে ঘরে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া দেখতেই পান। আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের টাকা নিয়ে ট্রলির ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথাও ঠারেঠোরে জানেন অনেকেই। হাসপাতালের ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা যদিও বলেন, “আমাদের স্টোরে ট্রলি মজুত থাকে না বললেই চলে। সমস্যাটা হল, এক ওয়ার্ডের ট্রলি অন্য ওয়ার্ডে চলে গেলে আর ফেরত আসে না। তখন ওয়ার্ডগুলিতে ট্রলির সংখ্যা কম-বেশি হয়ে যায়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর সংখ্যা এতটাই কম যে, ট্রলিগুলো ঠিকমতো ফিরে আসছে কি না তা নজর রাখতে পারেন না। আর টাকা নেওয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু লিখিত অভিযোগ তো কেউ করেন না।’’ তাঁর আরও দাবি, হাসপাতালের তরফে এই সব কারণে ‘কাউকে কোনও অর্থ দেবেন না’ বলে নিয়মিত প্রচার চালানো হয়। এই সব দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য সিসিটিভি লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে।

এখন সিসিটিভিতে টাকা দেওয়া-নেওয়া দেখে রোগীদের ট্রলি জোটে কি না সেই অপেক্ষাতেই রয়েছেন পরিজনেরা।

—নিজস্ব চিত্র।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE