আতঙ্কে দিন কাটছে পরিজনদের। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল
গ্রামের গা ঘেঁষে যাওয়া ভাগীরথীর চরে সে ভাবে চাষাবাদ হয় না। রোজগারের আশায় বহু দিন ধরেই ভিন্ রাজ্যে যান গ্রামের অনেকে। কিন্তু সেই বাইরে কাজ করতে গিয়ে কয়েকজন বিপাকে পড়ায় গোটা গ্রামেই যেন আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে কালনার কালীনগরে।
এক সময়ে এলাকা থেকে জাতীয় স্তরের বহু খেলোয়াড় উঠে আসায় ‘কবাডি গ্রাম’ বলে পরিচিত এই কালীনগর। দু’আড়াই দশক ধরে এই গ্রামের অনেকেই কাজের প্রয়োজনে রয়েছেন ভিন্ রাজ্যে। কিন্তু বাংলাদেশি সন্দেহে মুম্বইয়ের নানা থানায় তেমন কয়েক জন বাসিন্দাকে আটকে রাখা হয়েছে, বুধবার কালনা মহকুমা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন কালীনগরের বাসিন্দারা। তাঁরা কী ভাবে ছাড়া পাবেন, সে নিয়েই এখন চিন্তায় গোটা গ্রাম। ভয়ে অনেকে গ্রামেও ফিরে আসতে শুরু করেছেন সেখান থেকে।
পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘কালনার মহকুমাশাসককে বেশ কিছু নথিপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। সেগুলি পেলেই রাজ্যের তরফে মহারাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।’’ মুম্বই পুলিশের এসিপি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) রবীন্দ্র শিসভে বৃহস্পতিবার ফোনে শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। নথিপত্র আদালতেই পেশ করতে হবে।’’ রাজ্যের মন্ত্রী তথা পূর্বস্থলীর বিধায়ক স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আনব।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় আড়াই দশক আগে গ্রামের অনেকে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় কাজের সন্ধানে যেতে শুরু করেন। এখন কালীনগরের প্রায় সাড়ে তিনশো মানুষ সেখানে বাজার, দোকানের কর্মী, পরিচারিকা, গাড়ি চালক, রাজমিস্ত্রির সহকারী জোগাড়ে সহ নানান কাজ করেন মুম্বইয়ের নানা এলাকায়। ফোনে তাঁদের অনেকে জানান, ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা বলে তাঁদের কাছে পুলিশ প্রায়ই নথিপত্র চায়। ভোটার, প্যান বা আধার কার্ড দেখালেই ছেড়ে দেওয়া হতো। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে বিপত্তি শুরু হয়েছে।
ওই বাসিন্দারা জানান, ১৪ ডিসেম্বর থানেতে বাংলাদেশি সন্দেহে গ্রামের বাসিন্দা সফিকুল সরকার, কাজল শেখ, হাসিরা বিবি, রজিনা বিবি, আলিম শেখকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ২৫ জানুয়ারি রাতে নুরুল হক মোল্লা, রিনা বিবি, আজগর আলি মোল্লা, সুমন মোল্লা, রফিকুল মোল্লা ও নার্গিস খাতুনকে গ্রেফতার করা হয়। সে রাতে গ্রেফতার করা হয় হাওড়ার দু’জনকেও। এর পরেই আতঙ্কে ভুগছেন মহারাষ্ট্রের নানা জায়গায় কর্মরত কালীনগরের বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবার মুম্বই থেকে ফোনে আলি আকবর মোল্লা বলেন, ‘‘আমার ১২ বছরের ছেলে রকিবুল-সহ কয়েক জন আত্মীয়কে গ্রেফতারের সময় আমি গ্রামে ছিলাম। খবর পেয়ে ছুটে আসি। ওরা নানা জেলে বন্দি। দু’টি ছেলেমেয়েকে রাখা হয়েছে জুভেনাইল হোমে।’’ তিনি জানান, জেলবন্দিদের ছাড়াতে আইনজীবীদের কাছে দৌড়দৌড়ি করছেন। সে জন্য টাকা ও জামিনদার জোগাড়ের চেষ্টা হচ্ছে।
মাছ বাজারে কাজ করা বাবর আলি মেয়াজি ২৬ জানুয়ারি গ্রামে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘১৯ বছর কাজ করছি। পুলিশ নানা সময়ে নথিপত্র দেখতে চেয়েছে। পরিচয়পত্র দেখালে আর কোনও প্রশ্ন তোলেনি। এ বার কোনও কথাই শুনতে চাইছে না। ভোটার বা আধার কার্ড দেখালে ভুয়ো বলে সন্দেহ প্রকাশ করছে।’’ গ্রামের বাসিন্দা সুকুর আলি মিয়াজি, নুর আলম শেখরা বলেন, ‘‘সারা বছরই গ্রামের মানুষ মহারাষ্ট্রে আসা-যাওয়া করেন। এখন আর আমরা ওখানে কাজে যেতে সাহস পাচ্ছি না।’’ গ্রামের বাসিন্দা তথা প্রাক্তন কবাডি খেলোয়াড় হাবিব শেখের ক্ষোভ, ‘‘নিরীহ বাসিন্দাদের হেনস্থা করা হচ্ছে ওখানে। পুলিশকে বাড়ির পুরনো দলিল-সহ নানা নথি দিলেও মানতে চাইছে না।’’
এই গ্রামের বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন। সেটির সভাপতি সামিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘শুধু কালীনগর নয়, মহারাষ্ট্রের পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে হাওড়া-সহ নানা এলাকার মানুষকে ধরছে। কোথায় কত জনকে ধরা হয়েছে, তার তালিকা তৈরি হচ্ছে। আমরা গ্রেফতার হওয়া মানুষদের আইনি সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy