পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরে হিরোশিমা। ফাইল ছবি
যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান। ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্টের সকাল। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে এসেছে। বর্ষার শুরু। হাইড্রেনজিয়া, ল্যাভেন্ডার আর সূর্যমুখী ফুলেদের ফোটার সময়। দু’বছরের মিষ্টি মেয়ে সাদাকো সাসাকি ছিল হিরোশিমা শহরের মিসাসা সেতুর কাছে তার বাড়িতেই। সাসাকির বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটারের কিছু বেশি দূরে (যে জায়গাটি পরে পরিচিতি পাবে গ্রাউন্ড জিরো নামে) বিস্ফোরণ ঘটল পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমার, জাপানি ভাষায় ‘জেনশি বাকুদান’-এর। বিস্ফোরণের অভিঘাতে সাসাকি বাড়ির থেকে জানলা দিয়ে ছিটকে উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে। কিন্তু বেঁচে গেল অলৌকিক ভাবে।
কিন্তু বাঁচল কি? স্কুলের রিলেটিমের সদস্য সাসাকি এগারো বছর বয়সে আক্রান্ত হল রক্তের ক্যানসারে। বিস্ফোরণজনিত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবই এর কারণ। একই কারণে তার মতো আরও অনেকে, বিশেষ করে ছোটরা, আক্রান্ত হল এই জাতীয় অসুখে। পরে এই ‘পোস্ট রেডিয়েশন হ্যাজার্ড’ জাপানি ভাষায় পরিচিতি পেয়েছে ‘হিবাকুশা’ নামে। আর মাত্র এক বছরের আয়ু নিয়ে সাসাকি ভর্তি হল হাসপাতালে। তার বাবা তাকে বলেছিলেন ওরিগামি-তে (কাগজ ভাঁজ করে শিল্পের রূপ দেওয়ার জাপানি সংস্কৃতি) এক হাজার সারস তৈরি করতে পারলে মনের ইচ্ছে পূর্ণ হয়। সাসাকির মনের ইচ্ছে আবার তার স্কুলের রিলেটিমে যোগ দেওয়া। সাসাকি বিভিন্ন ভাবে কাগজ জোগাড় করে সেই চেষ্টায় মেতে উঠল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত শেষ করার তাড়নায় সকাল ঠিক সোয়া আটটায় আমেরিকার বি-২৯ যুদ্ধবিমান হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলা মাত্র এক ফুৎকারে নিভে যায় আশি হাজার মানুষের প্রাণপ্রদীপ। এর ঠিক তিন দিন পরে ৯ অগস্ট দুপুরবেলায় অন্য একটি বি-২৯ পারমাণবিক বোমা ফেলল নাগাসাকিতে। সেখানে তৎক্ষণাৎ মারা যান ৪০ থেকে ৭৫ হাজার মানুষ। ১৫ অগস্ট আত্মসমর্পণ করল জাপান। দুই শহর মিলে চার মাসের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ উনত্রিশ হাজারের থেকে দু’লক্ষ ছেচল্লিশ হাজারের মধ্যে।
আগে থেকেই মাঝে মাঝে বোমাবর্ষণ হচ্ছিল হিরোশিমায়। ৬ অগস্টের সকালে তাই শহর পরিষ্কার করতে নেমেছিল বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা। কলেজের এক জন ইতিহাসের অধ্যাপক পালিয়ে উঠেছিলেন হিরোশিমার পাশের হিকিয়াম পাহাড়ে। সেখান থেকে দেখা তাঁর বর্ণনা, ‘‘সে দিন দেখলাম হিরোশিমার কিছুই নেই। হিরোশিমা শহরটাই আর নেই। এর পর আমি অবশ্যই মর্মান্তিক দৃশ্য অনেক দেখেছি, কিন্তু সে দিনের স্তম্ভিত করে দেওয়া দৃশ্যের যে অভিজ্ঞতা তা প্রকাশ করা অসম্ভব।’’
হিরোশিমার উপরে ফেলা ন’হাজার পাউন্ডের দশ ফুট দীর্ঘ আঠাশ ইঞ্চি ব্যাসের ইউরেনিয়াম-২৩৫-এ তৈরি বোমাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লিটল বয়’। আর নাগাসাকির উপর ফেলা দশ হাজার দু’শো তেরো পাউন্ড ওজনের ১০.৭ ফুট দীর্ঘ ও পাঁচ ফুট ব্যাসের প্লুটোনিয়ামের বোমাটির নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’। বাংলায় অনুবাদ করলে আদুরে নাম ‘ছোটকু’ ও ‘মোটকু'। ‘লিটল বয়’ বহনকারী বিমানের নাম রাখা হয়েছিল তার পাইলট কর্নেল পল টিব্বেট্স-এর মা ‘এনোলা গে’-এর নামে। ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্দো মরু অঞ্চলে ট্রিনিটি পরীক্ষাকেন্দ্রে পারমাণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার মূল দায়িত্ব ছিল রবার্ট ওপেনহাইমারের হাতে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক আর্থার উইলিয়াম রাইডারের কাছে ১৯৩৩ সালে সংস্কৃত শিখেছিলেন। ওপেনহাইমার বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতার সঙ্গে গীতায় কৃষ্ণের বিশ্বরূপের তুলনা টেনে উচ্চারণ করেছিলেন একাদশ অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোক— ‘‘দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবদ্ যুগপদুথ্থিতা...’’। আর তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন তাঁর মনে পড়েছিল বত্রিশতম শ্লোকে বিশ্বরূপে কৃষ্ণের বাণী, ‘‘কালোহস্মি লোকক্ষয়তে প্রবৃদ্ধে..’’। তাঁর ভাষায়, ‘‘নাউ আই অ্যাম বিকাম ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’’।
সভ্যতা ও মানবিকতার উপরে এই বিভৎসতম আক্রমণের জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল নেহাত সন্দেহের বশেই। সন্দেহটি ছিল, হিটলারের জার্মানিতে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চলছে। নাৎসি আগ্রাসনে অনেক ইহুদী বিজ্ঞানী তখন আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায়। তার মধ্যে ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর প্রমুখেরা। ছিলেন লিও ঝালার্ডও। প্রধানত তাঁর উদ্যোগে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য মার্কিন সরকারকে চিঠি লেখা হয়। সেই চিঠিতে সই করেন আইনস্টাইনও। এর জন্য পরে তাঁকে অনুতাপের ভার বইতে হয়েছিল।
পরমাণু বোমা তৈরির প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’। এই প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে ছিল ‘ট্রিনিটি টেস্ট’। কিন্তু ১৯৪৩-’৪৪ সালেই আমেরিকা জেনে যায় জার্মানির কাছে কোনও পরমাণু বোমা নেই। আইনস্টাইন ও ঝালার্ড তখন পারমাণবিক বোমার ব্যবহার থেকে আমেরিকাকে নিবৃত্ত করতে প্রেসিডেন্ট রুজ়ভেল্টকে চিঠি লেখেন। কিন্তু রুজ়ভেল্ট মারা গেলেন ১৯৪৫-এর ১২ এপ্রিল। নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন ট্রুম্যান। প্রশ্ন ওঠে, এই রক্তাক্ত ইতিহাস অন্য ভাবে লেখা হতে পারত কি না? এ কি জাপানের সঙ্গে ঠিকঠাক কূটনৈতিক যোগাযোগ বা মধ্যস্থতার অভাব?
না কি আমেরিকার নিজেকে শ্রেষ্ঠ শক্তি প্রমাণের স্পৃহা?
মৃত্যু তার প্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার আগে সাসাকি নাকি ছ’শো চুয়াল্লিশটি কাগজের সারস তৈরি করতে পেরেছিল। তার বন্ধুরা এবং আত্মীয়-পরিজনেরা পরে তার স্বপ্নপূরণের বাকি সারস তৈরি করে। সেগুলি স্থান পায় তার কবরে। সাসাকি ও তার হাজার সারস পাখি নিয়ে যেমন গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে, তেমনই হয়েছে সিনেমাও। সোনালি সারস হাতে সাসাকির মূর্তি রয়েছে ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক’-এ। নীচে লেখা, ‘এ আমাদের কান্না। এ আমাদের প্রার্থনা। পৃথিবীতে আসুক শান্তি।’ সাসাকি হয়ে উঠেছে যুদ্ধবিরোধী আবেগ ও শান্তির প্রতীক।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy