শিশুকে নিয়ে আতঙ্কে মহিলা।
ছ’মাসে চার বার আগুন।
আকারে খুব বড় না হলেও গত ডিসেম্বর থেকে এ বছরের মে মাসের মধ্যে চারটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শুক্রবার প্রসূতি বিভাগে আগুন ফের বেআব্রু করে দিল সরকারি হাসপাতালের অগ্নি নির্বাপণ নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার ছবি।
এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে দমকলের কর্তারাও ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন, “প্রতি মাসেই হাসপাতালের কোনও না কোনও বিভাগে আগুন লাগছে। প্রতি ক্ষেত্রেই বৈদ্যুতিক সংযোগের সমস্যা বা শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই সব প্রস্তাব মানা তো হয়নি, উল্টে বৈদ্যুতিক-ব্যবস্থাও ঠিক মতো রক্ষনাবেক্ষণ হয় না।”
যে কোনও সরকারি হাসপাতালে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকে পূর্ত দফতর (বিদ্যুৎ)। শুক্রবারের ঘটনার পর ওই দফতরের এক কর্তাও স্বীকার করে নেন, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। হাসপাতাল সুপারের সামনেই তাঁর ব্যাখ্যা, “আর কত করব? এত বড় হাসপাতালে একজন মিস্ত্রী ও কর্মী দিয়ে রক্ষনাবেক্ষণ সম্ভব? তবুও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। কখনও কখনও ফাঁক থাকলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”
শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ প্রসূতি বিভাগের লেবার রুমের সামনে হঠাৎই ‘কন্ট্রোল প্যানেল’ বাক্স থেকে আগুন বের হতে দেখা যায়। ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় রোগী ও রোগীর পরিজনেদের। হাসপাতালের কর্মীরাই বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জল দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। তবে ততক্ষণে ওই ভবনের পাঁচ তলা ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে যায়। রোগী ও তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেক প্রসূতি বা সদ্যজাতদের নিয়ে মায়েরা নীচের তলায় যাওয়ার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। সিঁড়ি দিয়ে হুড়োহুড়ি করে নামতেও দেখা যায় অনেককে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসেন হাসপাতালের ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা। তাঁর কথায়, “অগ্নিসংযোগের কিছুক্ষণের মধ্যেই দমকলের দুটি ইঞ্জিন এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।”
হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন খণ্ডঘোষের বোঁয়াইচন্ডী গ্রামের দোলন মাড্ডি। তাঁর কথায়, “খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শিশুকে নিয়ে পড়িমরি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছি। এখন ভাবছি, ওই ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে যদি কিছু হয়ে যেত!” আউশগ্রামের সীতা মণ্ডল, মেমারির মৌলি হাঁসদারাও বলেন, “প্রায় সময়ই খবরে দেখি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগুন লেগেছে। আজ নিজের চোখে দেখলাম। ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নজর দেয় না কেন? রোগীরা কি মানুষ নয়!”
দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কয়েক বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে এই হাসপাতালে। গত বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সকালে শিশু বিভাগে আগুন লাগে। এ বছরের গোড়াতেই হাসপাতালের নতুন ভবনের এক তলায়, আর গত মাসে জরুরি বিভাগের তিন তলায় বার্ন ওয়ার্ডে আগুন লাগে। দমকলের কর্তারা জানান, হাসপাতালে এই মূহুর্তে ২৮০টি এসি চলছে। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন যন্ত্র বসানো হচ্ছে। কিন্তু মান্ধাতার আমলের বিদ্যুতের তার পাল্টানো হচ্ছে না। ওই তার ‘লোড’ নিতে পারছে না বলেই এই ধরণের অগ্নিসংযোগের ঘটনা হামেশাই ঘটছে বলেও দমকলের কর্তাদের দাবি।
পরপর ঘটনায় আতঙ্কে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকও। তাঁদের কথায়, “সব সময় ভয় লাগে। কখন যে কী হয়? লোকে তো আর জানবে না কারা বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষন করে! কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদেরই মাথা ফাটবে।” হাসপাতাল সুপার উৎপল দাঁ-র যুক্তি, “জরুরি ভিত্তিতে নিয়মিতভা ভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ রক্ষণাবেক্ষনের কাজ করার জন্য পূর্ত দফতর (বিদ্যুৎ)কে বলা হয়েছে। বাকি যে সব সমস্যা রয়েছে, আমরা তা দ্রুত কাটিয়ে উঠব।” এ দিন বিকেলেই হাসপাতালের সমস্ত বিভাগের কর্মীদের ও পূর্ত দফতরের (বিদ্যুৎ) সঙ্গে বৈঠক করেন ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বৈঠকে হাসপাতালের আর কোথায় কোথায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের প্রয়োজন এবং সেই যন্ত্র কোন কোন কর্মী চালাবে তার তালিকা নেওয়া হয়েছে। ওই কর্মীদের দমকল থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও পূর্ত দফতরের (বিদ্যুৎ) কর্তাদের বলা হয়েছে, প্যানেল বোর্ড গুলি নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। ওই বোর্ড গুলি নিয়মিত ভাবে পরীক্ষা হয় না বলেই বিদ্যুৎ সংযোগে গণ্ডগোল হচ্ছে এবং সেখান থেকে আগুন লেগে যাচ্ছে। পূর্ত দফতরের (বিদ্যুৎ) কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকবেন। কিন্তু কবে— তার সদুত্তর নেই কোনও পক্ষেরই।
ছবি: উদিত সিংহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy