মনোহর দাস (প্রিসাইডিং অফিসার)
এমনিতে সব ভালই ছিল। কেবল রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে গেল হাতি।
ভোট মিটিয়ে আসার দশ দিন পরেও খালি মনে হচ্ছে কাটোয়া থেকে দুর্গাপুর, সেখান থেকে পারাজ যাওয়ার কষ্টকর অভিজ্ঞতাও দাঁতালের গল্পের কাছে কিচ্ছু না।
আর মনে থেকে গিয়েছে দুই বিরোধী দলের এজেন্টের এক সঙ্গে তাঁদের গ্রামের কোড়া উৎসবে যাওয়ার আন্তরিক আমন্ত্রণ জানানো।
এ বারের বিধানসভা ভোটে গলসির পারাজের কাছে গোঁয়াইবাদ আদিবাসী পাড়া শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সেই মতো, ভোটের আগের দিন ভোর পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে বের হই। সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ বাসে চেপে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ পৌঁছে যাই দুর্গাপুর ডিসিআরসিতে। ঘামতে ঘামতে অপেক্ষার পালা চলে। দুপুর ২টো নাগাদ আমাদের চার ভোটকর্মীর হাতে নির্বাচন সংক্রান্ত জিনিসপত্র তুলে দেওয়া হয়। শুরু হয় বাসের মধ্যে আরক প্রস্থ গলদঘর্ম দশা। প্রায় দু’ঘন্টা বাসের ভিতর বসেছিলাম আমরা। ঘেমেনেয়ে রীতিমতো শরীর খারাপ করছিল। অবশেষে, বিকেল সাড়ে চারটের সময় বাস ছাড়ে। পানাগড়ের বিখ্যাত যানজট ঠেলে ৭টা নাগাদ পৌঁছই অভীষ্ট বুথ কেন্দ্রে।
পৌঁছে অবশ্য ক্লান্তি ধুয়ে যায় অনেকটাই। চারিদিকে ধান খেত। তার মাঝে শিশু শিক্ষাকেন্দ্রটির বুথটি। পাশেই রয়েছে সাবমার্সিবল পাম্প। বাস থেকে নেমে জিনিসপত্র ঘরে রেখেই হৈ হৈ করে স্নান করে নিলাম। গ্রামের বাসিন্দারাই যত্ন নিয়ে আমাদের চা খাওয়ালেন। কাগজপত্রের কাজ সেরে একটু রাত হতে স্কুল ঘরের সামনে উঠোনেই শতরঞ্চি পেতে সবাই মিলে গল্প করছিলাম। তখনই জানতে পারলাম, এই এলাকায় মাঝে মাঝে হাতি দেখা যায়। একের পর এক হাতির গল্প বলতে শুরু করলেন গ্রামবাসীরা। কীভাবে রাতের অন্ধকারে হাতি পিষে দিয়ে গিয়েছে, কী ভাবে ঘুমের মধ্যেই দাঁতাল ঢুকে পড়েছে— এমনই নানা গল্প। গল্প শোনার পর থেকেই ফাঁকা জায়গাটা আরও খাঁ খাঁ করতে লাগল। শুয়ে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু ভয়ে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। তবুও সারাদিনের ক্লান্তি আর ঠান্ডা হাওয়াতে চোখটা কখন যেন জুড়িয়ে এসেছিল। আচমকা কুকুরের প্রচণ্ড চিৎকার। ঘুম ভেঙে ধড়ফরিয়ে উঠে বসলাম আমরা। মনে পড়ে গেল, গ্রামের লোকজন বলছিলেন হাতি দেখলে কুকুর নাকি চিৎকার করে। বাকি রাত আর বালিশে মাথা ঠেকাতে পারিনি। কান, চোখ সজাগ রেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেগেই কাটাতে হল রাতটা।
পরের দিন ভোট শুরু হওয়ার ঠিক আগে বুঝতে পারলাম, যা অন্ধকার তাতে ইভিএম স্পষ্ট করে দেখতে পাবেন না ভোটারেরা। আবার জানলা খুলেও রাখা যাবে না। আমার অস্বস্তি দেখে দুই দলের এজেন্ট এক হয়ে আলোর ব্যবস্থা করে দিলেন। আর দেখলাম সেই বিরল দৃশ্য— দুই এজেন্ট এক ঠোঙা থেকে নিয়ে মুড়ি খাচ্ছেন। কোনও রকম তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই ৪১৬ জনের মধ্যে ৩৫৭ জন ভোট দিয়ে গেলেন। নির্বাচনের কাজ ভালই ভালই সেরে যেই বাসে উঠতে যাব, তখনই আবার হাজির দুই এজেন্ট।
ইভিএমটাকে চেপে ধরে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দু’জনেই হাসিমুখে বললেন, “স্যার, আগামী ১ মে আমাদের গ্রামে কোড়া উৎসব। আপনাকে আসতেই হবে। আপনি এলে আমাদের খুব আনন্দ হবে।” ওঁদের কথা শোনার পরে মুখ তুলে দেখি বেশ কিছু মহিলাও হাত নেড়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমার চোখে জল চলে এসেছিল।
দশ দিন কেটে গিয়েছে, কিন্তু ওই কথাগুলো ভুলতে পারছি না। সেই ২০০৬ সাল থেকে নির্বাচন করছি। কিন্তু এমন বিরল অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।
( লেখক নিগন দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কাটোয়া বিবেকানন্দ পল্লির বাসিন্দা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy