সামনেই অনুষ্ঠান। তার আগে পলেস্তারা খসেছে শ্রেণিকক্ষের দেওয়ালের। তাতেই চলছে ক্লাস। পুরনো ভবন (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র।
মোটা থামের লম্বা দালান। দেওয়াল চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ার দাগ স্পষ্ট। কোথাও কড়ি-বর্গা খসে পড়ছে, কোথাও ছাদের চাঙর ভেঙে পড়েছে। পা দিলে মনে হবে পোড়ো বাড়ি। কিন্তু পোড়ো বাড়ি নয়, এটি বর্ধমানের দুশো বছরের পুরনো রাজ কলেজিয়েট স্কুল।
১৯৮২ সালে এই স্কুল ভবনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিলেন জেলা প্রশাসনের বাস্তুকার। তা সত্ত্বেও জায়দগার অভাবে পুরনো ওই ভবনের পাঁচটি ঘরে স্কুল চালাতে বাধ্য হন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্লাসের মাঝেও আতঙ্ক ছাড়ে না। পড়াতে পড়াতে শ্রেণিকক্ষের ছাদের দিকে তাকিয়ে নেন শিক্ষক। ছাত্ররাও তাকায় দেওয়ালের দিকে।
আবার ২০০৭ সালের ২৮ মে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ‘হেরিটেজ’ তকমা দেয় রাজ কলেজিয়েট স্কুলকে। স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি অনাদিভূষণ কোনারের দাবি, হেরিটেজ ভবন সংস্কারের জন্য বারবার বলা হয়েছে প্রশাসনকে। তারপরেও বিপদের মধ্যে পরিত্যক্ত ঘরে ক্লাস করতে হচ্ছে। স্কুল সূত্রে জানা যায়, দু’শো বছরের প্রাচীন এই স্কুলটি রক্ষনাবেক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার। তৎকালীন টিআইসিকে নথিপত্র নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করতেও বলেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন টিআইসি গুরুত্ব না দেওয়ায় সরকারের ‘বিশেষ অনুদান’ পায়নি রাজ কলেজিয়েট স্কুল। অথচ এ বছরেই দুশো বছরে পা দেওয়া কলকাতার হিন্দু স্কুল ওই অনুদান পেয়েছে বলেও তাঁদের দাবি। স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, “আমরা বিষয়টি জানতাম না। জানার পরেই উপাচর্যের সঙ্গে দেখা করেছি। উনি প্রাক্তন এক ছাত্রকে আমাদের স্কুল নিয়ে একটা সার্ভেও করেছেন। আমরা নতুন করে উদ্যোগী হচ্ছি।”
বর্ধমান রাজ পরিবারের গবেষক নীরোদবরণ সরকার বলেন, “হিন্দু স্কুল তৈরির সময় মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজারা। তার পরেই বর্ধমানেও স্কুল তৈরির জন্য উদ্যোগী হন মহারাজা তেজচন্দ। প্রথমে রাজবাড়িতে, পরে রানির বাড়িতে স্কুল হয়। সেখান থেকে নতুনগঞ্জে স্কুলটি উঠে আসে ১৮৮২-৮৩ সালে।” ১৯১০ সালের ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’-এ বর্ধমানের তৎকালীন জেলাশাসক জে সি কে পিটারসন জানান, প্রথমদিকে স্কুলটির নাম ছিল অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল। নীরোদবরণবাবু জানান, নতুনগঞ্জের ভবনটি তৈরি হয় ১৮৮১ সালে, শেষ হয় পরের বছর। ওই ভবনে স্কুল উঠে আসার পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে কলেজের একটি শাখা চালু হয়। তখন থেকেই নাম হয় রাজ কলেজিয়েট স্কুল। মহাতাব চন্দের আমলে এই ভবনটি তৈরি করতে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়ল। ১৬ হাজার বর্গফুটের ভবনের স্কুলের ঘরগুলির উচ্চতা ২৫ ফুট।
স্কুলের পরিচালন সমিতির প্রাক্তন সম্পাদক বিমলকান্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “১৮৩৩ সালে তৎকালীন স্কুল পরিদর্শক বাংলা, বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি রাজ কলেজিয়েট স্কুলকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে জানিয়েছিলেন।” এই স্কুলের পড়ুয়া ছিলেন অভিনেতা কমল মিত্র, বিজ্ঞানী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখেরা। কিন্তু সেই স্কুলই আজ ধ্বংসের মুখে। স্কুলের পড়ুয়া শঙ্কর সাহা, রাজেন রায়দের কথায়, “স্কুলের পুরনো ভবনটি ভুতুড়ে বাড়ি। সেখান থেকে জল পড়ে, কাঠ ছেড়ে পড়ে। আবার ছাদের চাঙরও খসে পড়ে। যে কোনও সময় আমরা আহত হতে পারি।” ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, নতুন ভবনে ১১টি ঘর রয়েছে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ওই ঘরে কী প্রয়োজন মেটে? সে জন্য পরিত্যক্ত ভবনটিতে এখনও ক্লাস ও ল্যাবরেটরি রাখতে হয়েছে। তবে আমার আশঙ্কা, “ছেলেদের তো আর আটকানো সম্ভব নয়। তার তো এ ভবন- ও ভবন করছে। সেই সময় কিছু ঘটলে মুখ দেখাব কী করে, এই শঙ্কাতেই থাকি। শিক্ষা দফতরকে চিঠি পুরনো ভবন সংস্কারের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
স্কুল বাঁচানোর দাবি নিয়ে এবং দু’শো বছর উপলক্ষ্যে কাল, বৃহস্পতিবার প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়ারা পা মেলাবেন। বছরভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বর্ধমান জেলা পরিদর্শক (মাধ্যমিক) খগেন্দ্রনাথ রায় জানান, স্কুল সংস্কারের চিঠি শিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy