Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

লোভের শিকার পাখির দল, ঠুঁটো বন দফতর

এই সময়ে কলকাতা ও উত্তর শহরতলির বিভিন্ন খাল-বিলে ভিড় করে নানা প্রজাতির পাখি। সেই পাখি মেরে মাংস খাওয়া এবং বিক্রি করার লোভে সক্রিয় থাকেন পাখি শিকারিরা।

এ ভাবেই অবাধে চলছে পাখি শিকার।

এ ভাবেই অবাধে চলছে পাখি শিকার।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৫৬
Share: Save:

ফটাস করে একটা শব্দ! সঙ্গে সঙ্গে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মাটিতে এসে পড়ল সাদা রঙের পাখিটি। মৃত পাখিটিকে তুলে ডানা মুড়িয়ে ঢুকিয়ে নেওয়া হল পলিথিনের বস্তায়। একটা দুটো নয়, অসংখ্য পাখির যাত্রা এ ভাবেই ফুরোচ্ছে রোজ।

এই সময়ে কলকাতা ও উত্তর শহরতলির বিভিন্ন খাল-বিলে ভিড় করে নানা প্রজাতির পাখি। সেই পাখি মেরে মাংস খাওয়া এবং বিক্রি করার লোভে সক্রিয় থাকেন পাখি শিকারিরা। অনেকে আবার নিছক শখ করেও পাখি শিকার করতে আসছে। অভিযোগ, শিকারে অংশ নিচ্ছেন কলেজ পড়ুয়ারাও। গুলি করে মারার পাশাপাশি ফাঁদ পেতেও জীবন্ত পাখি ধরা হচ্ছে। মুরগির মতো করে সেই পাখি কেটে বিকোচ্ছে বাজারে। অভিযোগ, এ সবটাই ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনেই।

রাজারহাট, বাদু, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, ব্যারাকপুর, শাসন, খড়িবাড়ি, দেগঙ্গা, নীলগঞ্জ, আমডাঙা— এ সব অঞ্চলে ভিড় করে প্রচুর পাখি। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাখি মারার জন্য গাড়ি, মোটরসাইকেল নিয়ে বন্দুকবাজদের ভিড় জমতে থাকে এলাকায়।

বিষয়টি যে উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে, তা স্বীকার করে নিয়েছে বন দফতরও। দফতরের কর্তারা এ সব এলাকার পুলিশ, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকও করেছেন। উত্তর ২৪ পরগনার বিভাগীয় বনাধিকারিক মানিক সরকার বলেন, ‘‘খবর পেয়ে আমরা যখন ধরতে যাচ্ছি, তত ক্ষণে পালিয়ে যাচ্ছে শিকারিরা। তাই যে সব এলাকায় পাখি মারা হচ্ছে, সেখানে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করা হয়েছে।’’ যদিও এলাকাবাসীর দাবি, তাতে কোনও ফল মিলছে না।

মারার পরে পাখির ডানা মুড়ে ব্যাগে ভরে পাঠানো হচ্ছে বাজারে।

রাজারহাট সংলগ্ন খড়িবাড়ির ভেড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, নিউ টাউন থেকে গাড়ি চেপে শিকারে এসেছেন চার তরুণ-তরুণী। নাম জানাতে অনিচ্ছুক এক কলেজছাত্রের কথায়, ‘‘একটা শামুকখোল পাখি মারলে চার কিলোগ্রাম মাংস পাওয়া যায়।’’ অন্য এক শিকারি বললেন, ‘‘বকের চেয়ে মাছরাঙা শিকার করে আনন্দ বেশি। কারণ, মাছরাঙা খেতে বেশি ভাল।’’ এই পাখির মাংস দিয়েই ‘ভোজ’ হবে জানালেন ছেলেমেয়েরা।

আবার দেগঙ্গার সাতহাতিয়া বিলের ধারে দেখা গেল পরপর রাখা মোটরবাইক। স্থানীয়েরা জানান, মোটরবাইকে চেপে এসে বিলের চার পাশে ঘুরে পাখিনিধন চলছে। এয়ারগানের পাশাপাশি রয়েছে ছররা বন্দুকও। ওই শিকারিদের কথায়, ‘‘প্রতি দিন তিন-চার ঘণ্টায় গড়ে ২০টি পাখি শিকার হয়। ফাঁদ পেতে ধরা জীবন্ত পাখিগুলি এলাকার বাজার থেকেই বিক্রি হয়ে চলে যায় কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায়।’’ ডানা মুড়ে, পায়ে দড়ি বেঁধে, কিংবা খাঁচার মধ্যে রেখে দেদার পাখি বিক্রিও হচ্ছে ওই সব এলাকার বাজারে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ ভাবে লাগাতার শিকারের জন্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে পাখিদের আনাগোনা। বন দফতর জানাচ্ছে, এক সময়ে এই এলাকার বিয়েবাড়ির খাবারের মেনুকার্ডে চিকেন, মাটনের পাশাপাশি ‘অমুক পাখির মাংস’ আয়োজন করে নিজেকে জাহির করার প্রচলন ছিল। ধরপাকড় ও নজরদারির জন্য এখন তা বন্ধ। তবে পাখি মারার প্রবণতা বন্ধ হয়নি। মানিকবাবুর আক্ষেপ, ‘‘এত কিছু থাকতে নিরীহ, সুন্দর পাখির মাংস যে কেন খেতে হয় কে জানে!’’

—নিজস্ব চিত্র।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE