Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

আল আমিনের ছায়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওঁরা

মেরেকেটে বিঘে খানেক জমি আর বাড়ির পিছনের পানা-পুকুরে শ্রাবণ-ভাদ্রে জল পেলে ছোট চারা মাছ—বাটোয়ার কৈথন গ্রামে আয় বলতে এটুকুই। জনা দশ মানুষের পেল্লাই সংসারটা ওই এক মুঠো আয়ে টানা হ্যঁচড়া করে চালানোর পরে, ছেলেকে পড়ানোর আর সুযোগ ছিল না।

মনিরুল শেখ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৪:১৩
Share: Save:

মেরেকেটে বিঘে খানেক জমি আর বাড়ির পিছনের পানা-পুকুরে শ্রাবণ-ভাদ্রে জল পেলে ছোট চারা মাছ—বাটোয়ার কৈথন গ্রামে আয় বলতে এটুকুই। জনা দশ মানুষের পেল্লাই সংসারটা ওই এক মুঠো আয়ে টানা হ্যঁচড়া করে চালানোর পরে, ছেলেকে পড়ানোর আর সুযোগ ছিল না।

কৈথনের আটপৌরে মৌলানা সাইদুর রহমান ছেলে শেখ হাম্মাদুরকে নিয়ে সটান হাজির হন আল-আমিন মিশনের দরজায়। ‘‘দরজাটা খুলে গিয়েছিল তার পরই,’’ কবুল করছেন শেখ হাম্মাদুর, দিল্লির পরিচিত এক হাসপাতালের চিকিৎসক।

হাম্মাদুর একা নন।

কালনার প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মোমিন মণ্ডল ১৯৯৯ সালে মিশনে‌র হাওড়ার খলতপুর শাখায় পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। মিশনের ছায়ায় বড় হয়ে এখন তিনি চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস নিয়ে পড়াশোনা করছেন। বলছেন, ‘‘অভাবের সংসারে পড়ার কোনও সুযোগই ছিল না। মিশনে না পড়লে হয়তো মাঠে ঘাটে হারিয়ে যেতাম।’’

নদিয়ার নাকাশিপাড়ার প্রত্যন্ত বানগড়িয়ার সাজ্জাদ হোসেনও এখন চিকিৎসক। একাদশ শ্রেণিতে মিশনে না পা রাখলে এখনও তাঁর ঠিকানা যে বানগড়িয়াই হত সে ব্যাপারে নিশ্চিত ওই নবীন চিকিৎসক।

নিতান্তই দিন আনা দিন খাওয়া ঘরের এমন অজস্র হাম্মাদুর-সাজ্জাদ ছড়িয়ে রাজ্যের আনাচ কানাচে। যাঁরা চিকিৎসা-প্রযুক্তি কিংবা শিক্ষকতার উঠোনে এক একটা পরিচিত নাম। সৌজন্য আল-আমিন মিশন। গত তিন দশক ধরে গ্রামের দুঃস্থ মুসলিম ছেলেমেয়েদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার েয চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি তার স্বীকৃতি মিলল। রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রমের সঙ্গে রাজ্য সরকার আল-আমিন মিশনকে ‘বঙ্গভূষণ’ সম্মান দিল।

হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম খলতপুরের এক যুবক পেশায় স্কুল শিক্ষক নুরুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে ৬ মে নিজের গ্রামেই তৈরি করেন আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামি সংস্কৃতি কেন্দ্র’। কলেজ জীবনে কলকাতায় থাকাকালীন ভাষা শিক্ষার জন্য গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়মিত যাতায়াত ছিল নুরুলের। রামকৃষ্ণ মিশনের পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে সংখ্যালঘুর জন্য এই ধরনের আবাসিক প্রতিষ্ঠান তৈরির ভাবনা তাঁর। ১৯৮৭ সালে ইসলামি সংস্কৃতি কেন্দ্র নাম বদলে হয় আল-আমিন মিশন।

প্রাথমিক ভাবে মাত্রই ১১ জন পড়ুয়া নিয়ে চালু হয় মিশন। এখন সেখানে ছাত্র সংখ্যা ১১,৬৬৭ জন। খলতপুরের গণ্ডি পেরিয়ে মিশনের পরিধি ছড়িয়েছে এই রাজ্যের ১৫টি জেলায়। পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও অসমের বরপেটাতেও রয়েছে মিশনের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। গত তিন দশকে আড়ে-বহরে মিশনের কলেবর বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে উৎকর্ষতা। মূলত জয়েন্ট এন্ট্রান্সে প্রতি বছরই আল-আমিনের ফল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। গত বছেরও মেডিক্যালে প্রথম আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মিশনের ২১১ জন রয়েছে।

গত বছর ২১ জন পড়ুয়া কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পেয়েছেন। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পড়ছেন ২০ জন। এই সাফল্যের ধারা অব্যাহত ইঞ্জিনিয়ারিং শাখাতেও। মিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৩০ বছরে মিশন থেকে পাশ করা ৫৪৫ ছাত্র রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পেয়েছে। একইভাবে যাদবপুর-শিবপুর-দুর্গাপুর এনআইটি-র মতো নামী কলেজেও পড়ার সুযোগ পান ৯৭২ জন পড়ুয়া।

আল আমিনের দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের সিংহ ভাগ আসে পিছিয়ে পড়া জেলা মুর্শিদাবাদ থেকে। সরকারি সমীক্ষায় বলছে—মুর্শিদাবাদের বহু মানুষই পেটের টানে পরিযায়ী পাখির মতো ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে পা বাড়ান। কিন্তু গত দু-দশকে সেই মুর্শিদাবাদেও মিশনে পড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। মিশনের এক মুখপাত্র জানান, এই মুহূর্তে েজলার ১৯৭৮ পড়ুয়া মিশনের নানা শাখায় পড়ছেন। মিশন প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, “সকলে মিলে অনেকটা কাজ আমরা করতে পেরেছি। তবে সবটা নয়। এখনও অনেক কাজ বাকি।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE