বোমায় জখম বিজেপি কর্মী।
বোমা-গুলির লড়াইয়ে সেই পাড়ুই ফের অশান্ত। লড়াইয়ের এক দিকে তৃণমূল। অন্য দিকে এই মুহূর্তে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি।
বুধবার পাড়ুইয়ের ইমাদপুর গ্রামে যখন ওই সংঘর্ষ চলছে, তখন সেখান থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে পাড়ুই বাজার লাগোয়া মাঠে জনসভা করে তৃণমূলের ‘বিদায়ঘণ্টা’ বাজিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। দু’বছর বাদের বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে ঘোষণা করেছেন, “পাড়ুই থেকেই তৃণমূলের পতনের শুরু!” বিজেপি ক্ষমতায় এলে জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ‘পার পাবেন না’ বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আর রাহুলের সেই সভায় আসার পথে বিজেপি কর্মীদের উপরে গুলি-বোমা নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শেখ আনারুল নামে এক বিজেপি কর্মী। বোমার ঘায়ে আহত হন আরও পাঁচ বিজেপি কর্মী-সমর্থক। আনারুল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। বাকিরা অবিনাশপুরে সিউড়ি ২ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি।
রাজ্যের মন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “বিজেপি আসলে রাজ্যে গোলমাল বাধাতে চাইছে। তার পরে অভিযোগ করছে অন্যের নামে। কিছু সংবাদমাধ্যম বিজেপি-কে জোর করে তুলে ধরার চেষ্টা করছে!” তাঁর আরও বক্তব্য, “অন্য বিরোধীরাও (বাম ও কংগ্রেস) ওখানে যাচ্ছেন, সভা করছেন। বিজেপি গেলেই অশান্তি হচ্ছে কেন, এটা আমরাও জানতে চাই!”
কারণ আসলে একটাই। বীরভূমে বিজেপি-র ক্রম-উত্থান। রাজ্য রাজনীতিতে এখন বীরভূমকেই ‘পাখির চোখ’ করেছে বিজেপি। ফলে, শাসকদলের সঙ্গে তাদের সংঘাতও অনিবার্য হয়ে উঠছে। বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারের দাবি, “নিজের খাসতালুকে বিজেপি-র কাছে মাটি হারাতে দেখে মরিয়া অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর নির্দেশেই আমাদের লোকেদের উপরে হামলা হয়েছে।” এই প্রসঙ্গেই বিজেপি নেতারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৬ জুলাই বোলপুরে রাহুল সিংহের সভার কথা। সে দিনও সভায় যাওয়ার পথে মারধর করা হয়েছিল বিজেপি কর্মীদের, ভাঙচুর হয়েছিল তাঁদের বাসে। অভিযোগের তির ছিল তৃণমূলের দিকেই।
পাড়ুইয়ের বিজেপি নেতা শেখ সামাদের অভিযোগ, “সিউড়ির বনশঙ্কা ও অবিনাশপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গাড়িতে চেপে এ দিন আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা সভায় যাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে পাড়ুইয়ের তৃণমূল নেতা মুস্তাক হোসেনের ভাগ্নে সিরাজুল শা-এর নেতৃত্বে ইমাদপুরে জড়ো হয়েছিল তৃণমূল আশ্রিত সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। প্রথম গাড়িতেই বোমা-গুলি নিয়ে হামলা চালানো হয়।” পাড়ুইয়ের সাত্তোর বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেও সভায় যাওয়ার পথে তাদের তিন সমর্থককে তৃণমূলের লোকজন মারধর করেছে বলে বিজেপি-র অভিযোগ। সিউড়ি ২ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি নুরুল ইসলামের দাবি, সভায় যাওয়ার জন্য নয় বরং তৃণমূল প্রভাবিত ইমাদপুর গ্রাম দখলের লক্ষ্যে বিজেপি আশ্রিত ৭০-৮০ জন দুষ্কৃতী বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে লুঠপাট চালিয়েছে। নুরুল বলেন, “নারায়ণ মুখোপাধ্যায় নামে আমাদের এক কর্মীর পেটে তির লেগেছে। আরও দু’জনের গায়ে-মাথায় বোমার স্প্লিন্টিারের আঘাত লেগেছে। তিন জনই সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি।” সিরাজুল শা ওই সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছিও ছিলেন না বলে দাবি ওই তৃণমূল নেতার।
তির বিদ্ধ তৃণমূল কর্মী।
জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিআইবি) সূত্রের খবর, এ দিন সকালেই হরিশপুর গ্রামের এক বিজেপি সমর্থককে মারধর করেছিল ইমাদপুরের কিছু তৃণমূল সমর্থক। ছাড়া পেয়ে ওই যুবক নিজের গ্রামে ফিরে সব জানান। গাড়ি-মিছিল করে সভাস্থলে যাওয়ার পথে ইমাদপুরে এসে খবরাখবর নিতে শুরু করেন বিজেপি কর্মীরা। তখনই দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। দু’দলের লোকেদের হাতেই অস্ত্র ছিল।
জেলা বিজেপি সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল কিন্তু সংঘর্ষের কথা মানতে নারাজ। বরং তাঁর অভিযোগ, “আমাদের সভা পণ্ডের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। বোলপুরেও একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল ওরা। কিন্তু, এ ভাবে আমাদের রোখা যাবে না।” বোলপুরের ওই সভাতেই রাহুল সিংহ বলেছিলেন, “অনুব্রতর ঘরের মাঠে আমাদের জমায়েত দেখে তৃণমূলকে ভাবতে হবে! আগামী দিনে আরও মানুষ আমাদের দিকে আসবেন।”
বীরভূমের রাজনীতিতে বাস্তবে হয়েছেও তাই। গত কয়েক বছরে ওই জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডলকে এমন ‘কঠিন’ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেনি আর কোনও বিরোধী দলই। কিন্তু, জুলাইয়ের ওই সভার পর থেকে ‘কেষ্ট-ভূমে’ নিজেদের আরও সংগঠিত করেছে বিজেপি। বিশেষ করে কেষ্টর খাসতালুক হিসাবে পরিচিত বোলপুর মহকুমার ইলামবাজার ও পাড়ুই থানা অঞ্চলে একাধিক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম রাতারাতি ঘাসফুল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছে। ওই সব গ্রামের দখল ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমলও। তারই ফলশ্রুতি, গত ২৭ অক্টোবর পাড়ুইয়ের মাখড়া গ্রামে বিজেপি-তৃণমূলের সংঘর্ষ। মাখড়া পুনর্দখল করতে কয়েকশো সশস্ত্র দুষ্কৃতীকে নিয়ে তৃণমূল হামলা চালায় বলে অভিযোগ। বিজেপি প্রতিরোধ করে। দু’পক্ষের বোমা-গুলির লড়াইয়ে মারা যান তিন জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। এক জন বিজেপি সমর্থক।
পাড়ুই বাজারের সভায় বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর ছবি।
ওই সংঘর্ষের পরেই বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব সেখানে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল পাঠায়। আর তার পরেই এ দিনের সভা। বিজেপি-র দাবি, পাড়ুই বাজার লাগোয়া মাঠের ওই সভায় অন্তত ১০ হাজার লোকের ভিড় হয়েছিল (পুলিশের দাবি, ভিড় মেরেকেটে চার হাজারের)। সেই ভিড়ের একটা বড় অংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভিড় দেখে দৃশ্যতই সন্তুষ্ট রাহুল বলেন, “এত মানুষের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, কী ভাবে বিজেপি-র সমর্থন বাড়ছে। সিপিএমের শহিদ বেদি হয়েছিল নন্দীগ্রাম। আর পাড়ুইয়ে তৃণমূলের যাত্রা শেষ!” অনুব্রত মণ্ডলের উদ্দেশেও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি। বলেছেন, “মনে রাখবেন, ২০১৬ আসতে দেরি নেই। এ রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। অনুব্রত কিন্তু তখন পার পাবেন না! তাঁর শাস্তি হবেই।”
সভা চলাকালীনই বিজেপি কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পৌঁছে যায় মঞ্চে। বিজেপি নেতারা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে ফোন করে সব জানান। বোলপুরের এসডিপিও-র নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। দু’পক্ষের ছ’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
সব বিরোধী দলই কিন্তু বীরভূমে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মাখড়া-কাণ্ডেও পুলিশের বিরুদ্ধে হাত গুটিয়ে থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার দাবি, বীরভূমে যে ভাবে সংঘর্ষ বাড়ছে এবং পুলিশ যে ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে এনআইএ-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে ওই জেলায় অশান্তির ঘটনার তদন্তের ভার তুলে দেওয়া হোক। তাঁর কথায়, “পুলিশ কী করছ? তাদের ভূমিকা কী? বীরভূম জেলা তো পাকাপাকি ভাবে অশান্তির অবারিত দ্বার হয়ে উঠেছে!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানো এবং অশান্তি তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে চলছে তৃণমূল এবং বিজেপি। পুলিশ সেখানে একেবারেই নিষ্ক্রিয়।”
আর রাহুলের মন্তব্য, “এখানে আইনের রাজত্ব নেই। পুলিশ কর্তাদের বলব, আপনারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। বিজেপি-রও যদি কেউ অন্যায় করলে ব্যবস্থা নিন।” তাঁর কটাক্ষ, “পাড়ুই থানার ওসি বদল হচ্ছে বারবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই স্বরাষ্ট্র দফতর) বলব, পাড়ুইয়ের ওসি এ বার অনুব্রত মণ্ডলকে করুন!”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy