বহরমপুরে লাঠি হাতে দেখা গেল এই যুবকদের—১)সরফরাজ শেখ রুবেল, ২) সাজাহান শেখ, ৩) আকবর শেখ, ৪) আলমগীর শেখ।—নিজস্ব চিত্র
এদের কারও বাড়ি বহরমপুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে শাহাজাদপুরে। কারও বাড়ি খাগড়া রেলগেট লাগোয়া রানিনগর-শিয়ালমারা এলাকায়। তাদেরই তাণ্ডবে বুধবার দিনভর কাঁটা হয়ে রইল বহরমপুরে।
বুধবার সকালে সিপিএমের মিছিলের উপরে হামলা করে যারা, সেই তৃণমূল কর্মীদের অধিকাংশই শহরের বাইরের লোক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মী জানান, ‘‘হামলাকারীদের অধিকাংশ এসেছে ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ের বিভিন্ন এলাকা — উত্তরপাড়া, শিয়ালমারা, রানিনগর, শাহাজাদপুর, নিয়াল্লিশপাড়া-গোয়ালজান থেকে।’’
এদেরই কয়েকজনকে দেখা যায় তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের বড় ছেলে রাজীব হোসেনের সঙ্গেও। তাঁর নেতৃত্বে এক দল কর্মী-সমর্থক লাঠি-বাঁশ হাতে নিয়ে জেলা প্রশাসনিক কার্যালয়ে টহল দেয়, যাতে বামেরা সরকারি কর্মীদের দফতরে ঢুকতে বাধা দিতে না পারে। রাজীবের সঙ্গীদের কারও বাড়ি জমিদারি এলাকায়, কেউ এসেছেন ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ের শিয়ালমারা থাকে।
বহরমপুর শহর লাগোয়া হাটগাছা-গজধরপাড়া-নওদাপানুর-উস্তিয়া এলাকা থেকেও তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা ভিড় করেন সিপিএমের জেলা কার্যালয়ের সামনে। তার মধ্যে জইদুল শেখ নামে তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত সদস্যকেও লাঠি হাতে রণং দেহি মূর্তিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। সিপিএম-এর মিছিলে হামলার ঘটনার সময়ে সাদা পোশাকে হাজির-থাকা জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক অফিসার তৃণমূলের যে নেতা-কর্মীদের চিহ্নিত করেছেন, তাঁরা হলেন—সুতির মাঠ এলাকার লালচাঁদ শেখ ও যুগল শেখ, ভাকুড়ির অনিল মণ্ডল, উস্তিয়ার আজাদ শেখ, কাশিমবাজারের সেন্টু শেখ, ভাগীরথীর পশ্চিমপাড় লাগোয়া উত্তরপাড়ার মিলন শেখ, রানিনগরের জসিম শেখ, বিষ্ণুপুর বটতলার বাবুসোনা সাহা, শাহাজাদপুরের আলমগীর সেখ, গোয়ালজানের মানিক শেখ, রানিনগরের মানিক শেখ।
এ ছাড়াও সদ্য দলত্যাগ করে ছাত্র পরিষদ থেকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদে যোগ দেওয়া সরফরাজ শেখ রুবেলও ছিলেন সিপিএম-এর উপর হামলার ঘটনায়। নিজের উচ্চতার চাইতে আরও কয়েক ফুট লম্বা বাঁশ হাতে করে ঘুরে বেড়ান কাশিমবাজারের বাসিন্দা তৃণমূলের এক মহিলা নেত্রী।
কেন শহরে এত বহিরাগত? মান্নান হোসেনের দাবি করেন, তাঁর উপর সিপিএম আক্রমণ করেছে শুনেই ছুটে এসেছেন পরিচিতেরা। কিন্তু তাঁদের হাতে লাঠি-বাঁশ কেন? মান্নানবাবু জানান, ‘‘তৃণমূলের শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ের পাশেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে ঘেরা অনেক অস্থায়ী দোকান-ঘর রয়েছে। সিপিএমের আক্রমণের মুখে পড়ে নিজেদের বাঁচাতে ওরা ওই বাঁশ-কাঠ খুলে হাতে তুলে নেয়।’’
সিপিএম-এর অবশ্য অভিযোগ, নিজেদের বাঁচাতে নয়, বামপন্থীদের মারতেই এ দিন ব্যবহার হয়েছে বাঁশ। এদিন সকালে মোটরবাইকের পিছনের আসনে বসে বহরমপরে দলীয় কার্যালয়ে আসছিলেন ভাকুড়ি-২ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান সিপিএমের রঞ্জিত মণ্ডল। তিনি বহরমপুর টেক্সটাইল কলেজ মোড়ের কাছে আসতেই তাঁর মাথা লক্ষ্য করে বাঁশের আঘাত নেমে আসছে দেখে তিনি বাম হাতে করে বাধা দেন। তাতে তাঁর বাম হাতের হাড় ভেঙে যায়। আহত অবস্থায় তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁর হাতের কনুইয়ের উপর পর্যন্ত প্লাস্টার হয়েছে।
একই অবস্থা গোরাবাজারের সিপিএম কর্মী প্রৌঢ় অজিত মুখোপাধ্যায়ের। তৃণমূলের ছোড়া পাথর তাঁর মাথার পিছন দিকে লাগে। মাথা ফেটে যায় তাঁর। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে।
রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসানের অভিযোগ, ‘‘ছোট লরিতে করে ইঁট-পাথর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তৃণমূলের লোকজন। এদিন আমাদের লক্ষ্য করে তারা ইটবৃষ্টি করেছে। আমাদের এক জন মহিলা কর্মীর বুকে ওই পাথর এসে লাগে। গুরুতর জখম হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য মান্নান হোসেনের গাড়ির উপর ‘‘হামলা’’-ও তৃণমূলেরই পরিকল্পনা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘পূর্ব-পরিকল্পনা করেই তৃণমূলের জেলা সভাপতি আমাদের জেলা কার্যালয়ে ঢোকার মুখে নিজের গাড়ি রেখে যায়। আমাদের মিছিলে তৃণমূলের লোকজন হামলা চালালে আমাদের সমর্থকরাও প্রতিরোধ করার সময়ে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে।’’
এ দিন বনধে সিপিএমের মিছিলে আক্রমণ ও মান্নানের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ জমা পড়েছে বহরমপুর থানায়। তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তাতে মইনুল হাসান ও শেখর সাহার মতো নেতাদের নাম রয়েছে। অন্য দিকে, মান্নান হোসেন ও তাঁর ছেলে রাজীব হোসেন-সহ বেশ কয়েক জন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেছে সিপিএম নেতৃত্ব।
পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘অভিযোগ খতিয়ে দেখে দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ করা হবে।’’ পুলিশের কাজে বাধাদান ও পুলিশ কর্মীদের আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশও মামলা দায়ের করার দিকে এগোচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy