প্রথমে ফাটলো একটা চকলেট বোমা। ঠিক তার পরেই ‘শেল’-এর বিস্ফোরণের পিলে চমকানো শব্দ। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের দিক থেকে। তখন শনিবার সন্ধে সাতটা। যেটা পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা পড়ার সময়। কালীপুজোর রাতে শব্দদৈত্যকে বোতলবন্দি করে রাখা গেল কি না, বা সে বেরোলেও কতটা তাণ্ডব চালাতে পারল, তার পরীক্ষা। যাতে পরীক্ষার্থী পুলিশ-প্রশাসন।
তত ক্ষণে গড়িয়া, হরিদেবপুর, পশ্চিম পুটিয়ারি, পণ্ডিতিয়া রোড, রাসবিহারী মোড়ের আশপাশ ও কালীঘাট এলাকার কিছু বস্তি, ক্রিস্টোফার রোড থেকে চকলেট বোমা, দোদমা ফাটতে শুরু করেছে। ডিজি কন্ট্রোলে অভিযোগ আসছে চুঁচুড়া ও আশপাশের তল্লাট থেকেও। সাঁতরাগাছি স্টেশন লাগোয়া কোনা এক্সপ্রেসওয়ে বরাবর এলাকাগুলোও কেঁপে কেঁপে উঠছে। অভিযোগ আসছে যাদবপুর, টালিগঞ্জ, চারু মার্কেট থেকেও।
রাত বাড়তে, বিশেষ করে ঘড়ির কাঁটা ৯টা পেরোতে না পেরোতে শব্দবাজির তাণ্ডব অবশ্য আরও বাড়ল। খাস এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি এক হৃদ্রোগী অভিযোগ জানালেন— ‘‘কী বলব দাদা! হাসপাতালের মধ্যেই চকলেট বোমা ফাটানো হচ্ছে। কান ফাটানো সেই শব্দ আসছে কর্মীদের আবাসনের দিক থেকে।’’ পরিবেশকর্মীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-র নব দত্ত বললেন, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে শব্দসীমা ৯৫ ছাড়াচ্ছে, চার পাশে এতই বাজির তাণ্ডব। অথচ যে কোনও হাসপাতাল সাইলেন্স জোন-এর আওতায়।
গড়িয়াহাটের হিন্দুস্থান রোডের হীরকশুভ্র রায় জানালেন, ফ্ল্যাটে তাঁর বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে তিনি তিষ্ঠোতে পারছেন না, তাঁর মনে হচ্ছে তিনি শব্দদূষণের ঘেরাটোপে আটকে। একই সময়ে দমদম স্টেশনের আশপাশে ঘনঘন শেল ফাটতে লাগল। হাওড়ার শিবপুরের কয়েকটি তল্লাটে রাত সাড়ে আটটা থেকেই অবিরাম শব্দবাজি ফাটতে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই পাচ্ছেন না স্থানীয় মানুষ। গত বারের তুলনায় এ বছর শব্দবাজির তাণ্ডব অনেকটাই বেশি বলে অভিযোগ তাঁদের।
হবে না-ই বা কেন? হাওড়ার কামারডাঙা রোডের কিছু কিছু বাজির দোকানে এ দিন সকালেও একশো পিস চকলেট বোমা দেড়শো টাকায় বিকিয়েছে। দোকানদার সেগুলো ‘গোডাউন’ থেকে এনে সাফ বলছেন, ‘‘পুলিশের সঙ্গে সেটিং করে এই সব নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম তাই বেশি পড়বে।’’ হাওড়ার নেতাজি সুভাষ রোডে কালীবাবুর বাজারেও গোপনে নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি হয়েছে।
এ বার অনেকেই বলছেন— ঘিঞ্জি এলাকা, বস্তি বা কলোনি এলাকায় শব্দবাজির তাণ্ডব বেশি। কিছু কিছু অভিজাত বা বর্ধিষ্ণু এলাকা সেই তুলনায় কিছুটা শান্ত। তবে সেটা শিক্ষা, সচেতনতা, পুলিশের হাতে পাকড়াও হওয়ার ভয়ে নাকি আজ, রবিবার দেওয়ালির জন্য নীরব প্রস্তুতি, সেটা পুলিশ ও পরিবেশকর্মীরা ঠাওর করে উঠতে পারছেন না।
তবে রাত দশটার পরে উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলি জুড়ে বেশ বেড়েছে তাণ্ডব। সন্তোষপুর, কালিকাপুর, মুকুন্দপুর, অজয়নগর এলাকায় ভাল রকম প্রতাপ নিয়েই বোতল থেকে বেরিয়েছে শব্দদৈত্য। বাগুইআটি, কেষ্টপুর অঞ্চলে কান পাতা যায়নি বলে অভিযোগ।
পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় শব্দবাজির বিরুদ্ধে কঠোর, অথচ বিধাননগর পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাসবী দত্তের বাড়ি থেকেই এ দিন দুপুরে পুলিশ চকলেট বোমা-সহ ৫০ কেজি নিষিদ্ধ বাজি আটক করেছে। কাউন্সিলরের বাড়ি বাগুইআটি থানার অশ্বিনীনগর কাঠপোলের কাছে। পুলিশ সূত্রের খবর, বাসবীদেবীর বাড়ির পিছনে একটি জায়গা থেকে বাজি পাওয়া গিয়েছে। বাড়ির পিছন দিকটায় কাউন্সিলরের দেওর কানাইলাল দত্ত থাকেন। তিনি ফেরার বলে পুলিশ জানিয়েছে। সনাতন দলুই নামে কানাইলালবাবুর এক কর্মচারীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনা নিয়ে বাসবীদেবী মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর স্বামী তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা ভানু দত্ত বলেন, ‘‘ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।’’
রাত দশটার পরে লালবাজার কন্ট্রোল রুমের এক কর্তা জানালেন, ৫১টি অভিযোগ এসেছে শব্দবাজি নিয়ে। গত বার দীপাবলির সন্ধেতেও ওই অফিসারের ডিউটি ছিল কন্ট্রোল রুমে। তাঁর মনে আছে, গত বার রাত আটটার মধ্যে কন্ট্রোল রুমে শব্দবাজি সংক্রান্ত অভিযোগ দেড়শো ছাড়িয়েছিল। তাঁর দাবি, এই হিসেবের ভিত্তিতে অন্তত বলা যেতে পারে এ বার প্রথম রাতে শব্দবাজির তাণ্ডব আগের বারের চেয়ে কিছুটা হলেও কম। রাত ১২টা পর্যন্ত শহরে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪৩ জনকে। পুলিশের কাছে ৮০টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
কয়েক জায়গায় শব্দবাজি ফাটা শুরু হয়েছে খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছতেই সব শান্ত হয়ে যায়। হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে পুলিশকে ধরপাকড় করতে দেখা গিয়েছে। আবার সল্টলেকে পুলিশ কালীপুজোর রাতেও মাইক নিয়ে সকলকে সতর্ক করে। তবে পুলিশ চলে যাওয়া মাত্র বাজি ফাটানোও শুরু হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্রপুর-রাজপুর থেকেও অবিরাম শব্দবাজি ফাটার অভিযোগ এসেছে।
বেশি রাতে পুলিশের এক অফিসার বলেন, শব্দবাজির তাণ্ডব একেবারে বন্ধ করে দেওয়া গিয়েছে, এমন দাবি হয়তো করা যাবে না। তবে এ বার তার ব্যাপকতা কিছুটা কম ছিল বলে মনে হয়েছে। তাঁর বক্তব্য— নজরদারি ফাঁকি দিয়ে বহু শব্দবাজি বিক্রি হয়েছে। মোটা টাকায় যাঁরা সেগুলি কিনেছেন, তাঁরা তো ফাটবেনই। আজ না হলে কাল।
গত দু’সপ্তাহ ধরে শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া লালবাজারের এক কর্তা এ দিন দুপুরে বলছিলেন, ‘‘ভাল কিছু আশা করাই যায়। তবে খুব খারাপের মোকাবিলাতেও তৈরি আছি।’’
শব্দদৈত্য দমনের এই প্রস্তুতিই আরও কিছু আগে থেকে নিলে হয়তো আরও বেশি রোখা যেত তাণ্ডব, এমনটাই মত বিভিন্ন মহলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy