Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2021

Health Worker: কমান্ডারবাবু বাড়ি নেই

দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন কমান্ডারবাবুর স্ত্রী। জ্বরে আক্রান্ত কন্যার পিতাকে, যন্ত্রণা কাতর মহিলার স্বামীকে, মদমত্ত চা শ্রমিকের রমণীকে মৃদু বকে দেন।

n কমান্ডারবাবুর স্ত্রী, পোলিয়ো-দিদি মিতালি নন্দী সেন।

n কমান্ডারবাবুর স্ত্রী, পোলিয়ো-দিদি মিতালি নন্দী সেন। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক

অনির্বাণ রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ ০৭:১৬
Share: Save:

এক আছেন ‘কমান্ডারবাবু’। তাঁর এক ফালি বাগানে দোপাটি, জবা, টগর, রঙ্গন, কলাবতী। কলাবতী ফুলের এক নাম সর্বজয়া। কমান্ডারবাবু সে সব জানেন। রাতবিরেতে তাঁর দুয়ারে কেউ না কেউ আসবেই। তাঁরা ডাকেন, ‘‘বাবু, ও কমান্ডারবাবু। বেটিটার খুব বুখার।’’ কেউ বলে, “ও কমান্ডার, বউটা ব্যথায় কাঁদে।” কেউ ঝাঁঝিয়ে বলেন, “কমান্ডার, মিনসে ব্যাটা মদ গিলে মাথা ফাটায় ফেলছে। ওষুধ দেন।”

দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন কমান্ডারবাবুর স্ত্রী। জ্বরে আক্রান্ত কন্যার পিতাকে, যন্ত্রণা কাতর মহিলার স্বামীকে, মদমত্ত চা শ্রমিকের রমণীকে মৃদু বকে দেন। ‘‘কমান্ডারবাবু বলিস কেন রে! তোদের বাবু কি যুদ্ধ করেন? কম্পাউন্ডার বল।’’ তিনি ওয়াশাবাড়ি চা বাগানের ফার্মাসিস্ট। চিকিৎসক ডাকেন ‘কম্পাউন্ডারবাবু’। সেই থেকে চা শ্রমিকদের মুখে তিনি ‘কমান্ডারবাবু’।

চা বাগান থেকে সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ে বটগাছের ছায়ায় চায়ের দোকানে, গ্রামের হাসপাতালের শিশু কোলে দাঁড়িয়ে থাকা মায়েদের লাইনে। সে ডাক শুনতে হয় তাঁর স্ত্রীকে। তিনি সরকারি নার্স। তাঁকে সাত জায়গায় যেতে হয়। গোলাপি শাড়ি পরে বাক্স কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পোলিয়োর প্রতিষেধক খাওয়াতে হয়। গ্রামের হাসপাতালে ভিড় করা মায়েদের এবং শিশুদের শরীর-স্বাস্থ্য পরখ করতে হয়। সেই মায়েদের লাইনেই তিনি শোনেন, “এই দিদির বর চা বাগানের কমান্ডার।” কমান্ডার কেন রে? উনি কি যুদ্ধ করেন?

কিন্তু সে তল্লাটে কে আর বোঝে অতশত যুক্তি কথা! এক দিন শিশু কোলে মায়েদের কেউ এক জন তাঁকেও বলেন, “আপনাকেও তো আমরা পোলিয়োদিদি বলে ডাকি। কমান্ডারের বউ আমাদের পোলিয়ো-দিদি।’’ শুনে দিদি চোখ পাকিয়ে তাকান। কিন্তু মুখে হাসি ছড়িয়ে যায়। বাড়ি ফিরে স্বামীকে বলেন, “তুমি হলে কমান্ডার। আমি হলাম পোলিয়ো-দিদি।” দু’জনে হাসেন। পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসে মেয়ে। “তোমরা হাসছ কেন, আমাকেও বলতে হবে। বলো! বলো!” শুনে মেয়েও হাসে। তার পর বলে, “আমি কিন্তু ডাক্তার হব।” হাসি ছড়াতে থাকে চা বাগানের কোয়ার্টারের সামনে বাগানে, দোপাটি, টগর, জবা, রঙ্গনে। দোপাটি, রঙ্গনেই তো শরৎ আসে।

গত বারও এসেছিল। হইহই করে তিন জনে পুজোর বাজার করতে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়িতে। মা-মেয়ে বাসে। আর সত্তর কিলোমিটার পথ উজিয়ে ওয়াশাবাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি গিয়েছিলেন কমান্ডারবাবু। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে ফিরতে হবে যে। ফেরার পথে নেমেছিল বৃষ্টি। কমান্ডারবাবু থামেননি। হাসপাতালে সে দিন করোনা রোগী। কমান্ডারবাবুর ভয়ডর নেই। সকলেরই কাছে যান, ওষুধ দেন। দু’দিন পর থেকে জ্বরে পড়লেন কমান্ডারবাবুও। সে প্রবল জ্বর। জ্বর এল পোলিয়ো-দিদিরও। ডাক্তার হতে চাওয়া মেয়েটারও। নিজেরা বললেন, “স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। যা ইচ্ছে খাইয়ে দিয়ো না।” তখনও হাসছেন সকলে। রিপোর্ট এল, তিন জনেই করোনা আক্রান্ত। তার পর, অ্যাম্বুল্যান্স এসে তিন জনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিছু দিনের মধ্যে আইসিইউ-তে নিতে হল কম্পাউন্ডারবাবুকে। তাঁর তখন শ্বাসকষ্ট।

তার পর? পোলিয়ো-দিদি কথা থামিয়ে দিয়েছেন। বিছানার পিছনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বাবা-মেয়ের প্রিয় ক্যারামবোর্ড। উল্টো দিকের দেওয়ালে কম্পাউন্ডারবাবুর স্টেথোস্কোপ। দেওয়াল জুড়ে গণেশ, লক্ষ্মী-নারায়ণ, কালী, দুর্গার ছবি। কিন্তু সব ক্যালেন্ডার ২০২০ সালের। সময় কি থমকে গিয়েছে?

পোলিয়ো-দিদি ঘড়ি দেখেন। গ্রামের হাসপাতালে কত মা অপেক্ষায়। ওঁরাও তো খোঁজ নিয়েছিল সে সময়ে। তিনি সুস্থ হয়ে ফেরার পরে বারবার জানতে চেয়েছিলেন ওঁরা, “ও দিদি, কমান্ডারবাবু কেমন আছেন?”

পোলিয়ো-দিদি উঠে পড়েন। পরনে গোলাপি রঙের শাড়ি। কাঁধে সরকারি ব্যাগ। এক ফালি বাগানটা পেরিয়ে দিদি হেঁটে যাবেন আবার চা বাগানের পথ দিয়ে। ঘাস থেকে উড়ে যাবে দু’একটা ফড়িং। কোন প্রসূতির করোনার উপসর্গ, কোন শিশুর জ্বর, ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেবেন। তাঁদের করোনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করবেন। শরীর বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে পাঠাবেন। রোগীর এত কাছাকাছি যাওয়া, ভয় করে না?

জলপাইগুড়ি জেলা স্বাস্থ্য দফতরের স্বাস্থ্য সহায়িকা (এএনএম নার্স), পোলিয়ো-দিদি মিতালি নন্দী সেন বলেন, “সে দিনও তো করেনি। চা বাগানের হাসপাতালে এক জন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। আমি জানতাম, উনিও জানতেন। জেনেবুঝেই তো ওষুধ দিতে গিয়েছিলেন রোগীকে। আমিও তো বারণ করিনি।” দমকা হাওয়ার মতোই পরপর কথারা আসে, স্মৃতি কয়েক পাক ঘুরে যায়। তার পর আসে নীরবতা। বাগানের কোয়ার্টারের কাঠের সিলিং থেকে ঝোলা পাখাটি শব্দ করে ঘুরে চলেছে।

পোলিয়ো-দিদি বলতে থাকেন, “আমি নিজে সুস্থ হওয়ার কিছু দিন পরেই কাজে যোগ দিয়েছিলাম। তখন ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্সের অনেক কাজ ছিল। মনটাও ভাল ছিল না। হঠাৎ কী মনে হল, কয়েক দিনের ছুটি চাইলাম। দেয়নি। তার পর জেদ চেপে গেল। গত পুজো থেকে এই পুজো, এক দিনও ছুটিই নিইনি। জেদ করে।”

মেয়ে এসে দাঁড়ায় মায়ের কাছে। হাত রাখে মায়ের কাঁধে। মেয়ে এ বারে ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছে। তার হাত টেনে পাশে বসান মা। বলতে থাকেন, “ক’দিন আগে জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। একটা ছাপা শাড়ি কিনেছি দুর্গা ঠাকুরের জন্য। মেয়েই বলল।”

কী বলেছিল মেয়ে? বলেছিল, “এ বার শুধু দুর্গা ঠাকুরের জন্য একটা শাড়ি কিনব! বাবা খুব ঠাকুর মানে!” আপনি মানেন না? আপনি
পুজো করেন? “আগে করতাম। এখন সময় পাই না। মাঝেমধ্যে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিই।’’ ফের ঘড়ি দেখেন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী। তার পর আনমনা হয়ে বলেন, “এই কোয়ার্টার আমাদের ছেড়ে দিতে হবে।” জানান, এ বারও সপ্তমীর দিন ওঁরা জলপাইগুড়ি রওনা হবেন। সেখানেই পুজো কাটাবেন মা আর মেয়ে।

গত সেপ্টেম্বরে কমান্ডারবাবু সত্যি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ফেরেননি। যুদ্ধ শেষের দিন শ্বাসকষ্টে ছটফট করেছিলেন ওয়াশাবাড়ি চা বাগানের হাসপাতালের কম্পাউন্ডার সঞ্জয় সেন।

পোলিয়ো-দিদি চোখ মোছেন। দোপাটি, টগর, কলাবতী, রঙ্গনের বাগানের পাশ দিয়ে এগিয়ে যান।

কমান্ডারবাবু বাড়ি নেই।

কিন্তু সামনে যুদ্ধ অনন্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2021 Health worker Covid 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy