আনজুয়ারা বিবি। —ফাইল চিত্র।
রাতবিরেতে এক ডাকে কত অসুস্থ মানুষকে নিয়ে ছুটেছেন হাসপাতালে। অনেক সময়ে ডাকতেও হয়নি, খবর পেয়ে নিজেই ছুটে গিয়েছেন সেবা-শুশ্রূষায়। সেই মানুষটিই ধান শুকোতে দিতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বাড়ির ছাদ থেকে। চোট পান মাথায়, হাতে-পায়ে। ৯ মে সেই ঘটনার আট দিন পরে, রবিবার কলকাতার কম্যান্ড হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরল আনজুয়ারা বিবির (৫১) কফিন-বন্দি দেহ। বনগাঁর চাঁদায় জামতলার বাড়ি তখন উপচে পড়ছে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। চোখের জলে সকলে শেষ বিদায় জানালেন প্রিয় মানুষটিকে।
শুধু অসুস্থ মানুষের সেবাই নয়, ‘দশ হাত নিয়ে’ গ্রামের লোকের নানা প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতেন প্রত্যন্ত গ্রামের এই বধূটি। কারও মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় হচ্ছে না, কারও ওষুধ কেনার টাকা নেই, কারও পরিবারে হাঁড়ি চড়ছে না— সব ক্ষেত্রেই মুশকিল আসান ছিলেন আনজুয়ারা, গাঁয়ের লোকের কারও কাছে যিনি ‘ভাবি’ (বৌদি), কারও কাছে ‘মা’।
সারা জীবন প্রচারের আলোর বাইরে থাকতে চাইলেও বার বারই তাঁর দরদি মনের হদিস খুঁজে নিয়েছে সংবাদমাধ্যম। বহু পুরষ্কার পেয়েছেন নানা সময়ে। নিজের গ্রামে পারিবারিক জমিতেই তৈরি করেছিলেন অনাথ আশ্রম। নানা জায়গা থেকে বাপ-মা হারা কত ছেলেমেয়েকে এনে রেখেছেন সেখানে। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন, স্নান করিয়ে দিতেন। স্কুলে ভর্তি করতেন। তাদেরই এক জন বছর এগারোর আকাশ দাস। ‘দিদিমণি’র মৃত্যুর খবর পেয়ে চোখের জল থামতে চাইছিল না তার। গ্রামের অনেককে বলতে শোনা গেল, ‘‘নিজের মাকে তো চোখেই দেখেনি ছেলেটা। দ্বিতীয় বারের জন্য মাতৃহারা হল।’’
গ্রামে একটি চিকিৎসা শিবিরও চালাতেন আনজুয়ারা। নানা জায়গা থেকে চিকিৎসকদের ডেকে ডেকে নিয়ে আসতেন। নিজেই ওষুধপত্র জোগাড় করতেন চেয়ে-চিন্তে। কখনও বিশাল কোনও অনুদান আসেনি। কিন্তু কিছু মানুষ নানা সময়ে আর্থিক সাহায্য করেছেন আনজুয়ারাকে।
তবে সে সবের তোয়াক্কা না করেই মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে গ্রামের মানুষকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতেন, সকলে মিলেমিশে থাকতে হবে। কোথাও যেন কোনও অশান্তি না হয়।
গাঁয়ের কিছু মানুষ সে সব প্রথমটায় ভাল চোখে দেখেননি বলাই বাহুল্য। কিন্তু স্ত্রীর পাশে সব সময় থেকে সাহস জুগিয়েছেন আনজুয়ারার স্বামী নজরুল ইসলাম মণ্ডল। নজরুলের কথায়, ‘‘ও বরাবরই মানুষের সেবা করতে চাইত। দিন নেই রাত নেই কারও বিপদ-আপদের কথা শুনলে আর স্থির থাকতে পারত না। আমি ওর এই ইচ্ছেকে কখনও অসম্মান করিনি।’’
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী আনজুয়ারা নিজের কাজ নিয়ে কখনওই বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখাননি। বলতেন, ‘‘আমাদের স্বচ্ছল পরিবার। স্বামীর চাষবাস আছে। দুই ছেলের এক জন সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে গিয়েছে। এখন আমার আবার কীসের চিন্তা। মানুষের জন্য মানুষের তো এটুকু করারই কথা।’’
তবে আনজুয়ারার মৃত্যুতে গাঁয়ের মানুষের দিশাহারা অবস্থা। বহু বাড়িতে রান্না চাপেনি এ দিন। চোখের জল বাঁধ মানছিল না মমতা বিশ্বাস, নেপাল বালাদের। বললেন, ‘‘কত রকম ভাবে ওঁর কাছে সাহায্য পেয়েছি, বলে শেষ করার নয়। এ বার আমাদের পাশে আর কে দাঁড়াবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy