মধুসূদন হেমব্রম (বাঁ-দিকে) ও মহম্মদ সোহরাব মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
সাড়ে তিন বছরের শিশুটিকে সাপে কেটেছিল। তাকে বাঁচাতে ওন্দার হাসপাতাল থেকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পাঠানোটাই যথেষ্ট ছিল না। ৪৫ মিনিটের যাত্রাপথে জরুরি ছিল অ্যাম্বুল্যান্সে চিকিৎসকের সক্রিয় উপস্থিতি। মরণাপন্ন রোগীর স্বার্থে সেটাই করলেন ওন্দা হাসপাতালের চিকিৎসক মধুসূদন হেমব্রম। সারা রাস্তা অ্যাম্বুল্যান্সে বসে শিশুটির শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার যন্ত্র পাম্প করে গেলেন তিনি। তিন দিনেরও বেশি কোমায় থাকার পরে শিশুটি এখন বিপন্মুক্ত। চিকিৎসক ও রোগীর পারস্পরিক সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি যখন শোচনীয় মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে, সেই দুঃসময়ে বিচক্ষণ চিকিৎসকের মমত্ব দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে ওন্দার শ্যামনগরের বাড়িতে বল নিয়ে খেলছিল মহম্মদ সোহরাব মণ্ডল। খেলতে খেলতে বল খাটের তলায় চলে যায়। সেটি আনতে গিয়ে সাপের ছোবল খায় শিশু। তবে কিসে কামড়েছে, মা জিন্নাতুনকে তা জানাতে পারেনি সোহরাব। অল্প সময়েই শিশুটি দু’-তিন বার বমি করে। স্ত্রীর ফোনে সব শুনে ওঝা নয়, প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে ওন্দা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে যান শিশুর বাবা গোলাম মোর্তেজা মণ্ডল।
মধুসূদনবাবু জানান, শিশুটি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস ক্ষীণ। ন্যূনতম ৯৫ শতাংশের জায়গায় অক্সিজেন স্যাচুরেশন ছিল ৫০-৬০ শতাংশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সোহরাব নিউরোটক্সিক সাপের কামড় খেয়েছে। ওষুধ দেওয়া হয়। ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ তকমা থাকলেও ওন্দা হাসপাতালে আইসিইউ নেই! শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখতে ‘অ্যাম্বুব্যাগ’ই ছিল ভরসা। এই পদ্ধতিতে শ্বাসনালিতে ঢোকানো টিউব অক্সিজেন সরবরাহকারী একটি বেলুনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ওই বেলুন ঠিক মাত্রায় পাম্প করে অক্সিজেন পাঠাতে হয় ফুসফুসে। কিন্তু এ ভাবে বেশি ক্ষণ টানা সম্ভব ছিল না। মধুসূদনবাবু বলেন, ‘‘শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার দু’টি উপায়। ১) যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া অর্থাৎ ভেন্টিলেটর। ২) অ্যাম্বুব্যাগ। কিন্তু যন্ত্রে সেই প্রক্রিয়া যতখানি নিখুঁত হবে, হাতে সেটা সম্ভব নয়।’’ বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে ফোন করে জানা যায়, আইসিইউয়ে একটি শয্যা খালি আছে। কিন্তু সেখানেও প্রতিকূলতা। চিকিৎসক বলেন, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্সে অ্যাম্বুব্যাগে কী ভাবে, কতখানি চাপ দিতে হবে, তার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। রোগীর আত্মীয়দের তা জানার কথা নয়। তা ছাড়া গ্রামের অ্যাম্বুল্যান্সে কোথায় মনিটর!’’ তাই নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সারা রাস্তা ‘অ্যাম্বুব্যাগ’ পাম্প করার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে পড়েন তিনি।
রাত প্রায় ৮টা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছয় বাঁকুড়ায়। সোহরাবের অবস্থা দেখেই তাকে ‘পিকু’ বা পিআইসিইউ-এ ভর্তি করে নেন হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক বাপন কবিরাজ। বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, “প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে অ্যাম্বুব্যাগ চালিয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসা সহজ নয়।’’ সর্পদংশন চিকিৎসা প্রশিক্ষণে রাজ্য সরকারের রিসোর্স পার্সন দয়ালবন্ধু মজুমদার বলেন, ‘‘রোগীকে রেফারেল সেন্টারে চিকিৎসক নিজের দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছেন, এমন খবর শোনা যায় না। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কে দেখবে, সেই সঙ্কট তৈরি হয়। ওই চিকিৎসক যা করেছেন, তা নজিরবিহীন।’’
‘‘রোগীর স্বার্থে যা করার করেছি। আমার সঙ্গী চিকিৎসক মৌসুমী কুণ্ডু, মৌসুমী সাধুখাঁ, চিত্রাঙ্গদ ভোঁসলে ও দীপঙ্কর বসুমাতা, নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। ওঁদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না,’’ বললেন মধুসূদনবাবু। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে সৌম্য সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘ওই চিকিৎসকের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। হাসপাতালে গেলে যে সাপে কাটা রোগীর প্রাণ বাঁচে, তা-ও প্রমাণিত হল। সব প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই পোর্টেবল ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা উচিত।’’
শিশুটির বাবা বললেন, ‘‘ওই চিকিৎসকের জন্য ছেলে বেঁচেছে। উনি সোহরাবের মধুসূদন দাদা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy