তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে সুব্রত বক্সীই দলের রাজ্য সভাপতি। — ফাইল চিত্র
আশির কাছাকাছি এসে কি তিনি বৃদ্ধ হলেন? না কি বনস্পতির ছায়াটুকু রেখে ‘নতুন’কে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময় বলে মনে হচ্ছে তাঁর? শনিবার তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে যে ভাবে আচমকা দলের রাজ্য সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খানিক নড়েচড়ে বসেন। এবং ব্যাপারটা আর গড়াতে না-দিয়ে তিনি থামিয়ে দেন সুব্রত বক্সীকে। বলেন, এখন এই বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। পরে এ সব ভাবা যাবে।
বক্সী যখন তাঁর দায়িত্ব ছাড়ার কথা বলছেন, তখন তাঁর ডান পাশে মমতা। বাঁ পাশে বসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের আজন্ম রাজ্য সভাপতি বলতে চেষ্টা করেছিলেন, অসুস্থতার কারণে যে হেতু আর একেবারেই দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না, তাই তাঁকে সরিয়ে অভিষেককে রাজ্য সভাপতির আসনে বসানো হোক। মমতা সেই প্রসঙ্গ থামাতে বলায় বক্সী অবশ্য বাকি বক্তৃতায় আর ওই সব কথা তোলেননি। কিন্তু বৈঠকের পরে তৃণমূলের এক মধ্যবয়সি নেতাকে ঘটনার কথা বলতে বলতে আবেগতাড়িত শোনাল, ‘‘দলের জন্ম থেকে দিদি ছাড়া আর যাঁদের মাথার উপর পেয়েছি, তাঁদের এক জন থেকেও নেই। আছেন শুধু বক্সীদা। বক্সীদাও সরে যাওয়া মানে তো পার্টিতে ওই প্রজন্মটাই শেষ!’’
সুব্রত বক্সী তৃণমূলে ‘বক্সী’ বা ‘বক্সীদা’ বলেই পরিচিত। বাংলার রাজনীতিতে ‘সুব্রত’ বললে অধুনাপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও কথা এখনও মনে পড়ে না। তাই বোধহয় পদবি পরিচয়েই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হয়ে গিয়েছিল ‘বক্সী’। রাজনীতিতে অনুজপ্রতিম হলেও তৃণমূলে সুব্রতের থেকে বক্সী ‘বড়’ ছিলেন বরাবরই। এবং দলে তাঁর আর এক নাম ‘পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট’।
এবং তাঁর সেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নতুন প্রজন্মের নেতা অভিষেকেরও সিলমোহর পেয়েছে। ঘনিষ্ঠমহলে রসিকতা করে হলেও অভিষেককে বলতে শোনা গিয়েছে, সুব্রত বক্সী পুরনো এবং নতুন— দুই তৃণমূলেই সমান স্বচ্ছন্দ। অর্থাৎ, তৃণমূলের ‘বাক্স’ বদলালেও ‘বক্সী’ বদল হয় না। হবে না। শনিবার যে কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল দলের সর্বময় নেত্রী মমতার কন্ঠেও।
‘আদি’ তৃণমূলের নেতা হয়েও কী ভাবে তিনি ‘নতুন’ তৃণমূলের নেতৃত্বের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন? আনন্দবাজার অনলাইনের এমন প্রশ্ন শুনে খানিক বিরক্তই হয়েছিলেন ‘বক্সীদা’। ছ’ফুট আড়াই ইঞ্চির দেহের মুখটা নীচের দিকে ঝুকিয়ে কর্কশ গলায় তাঁর জবাব এল, ‘‘যারা তৃণমূলের মধ্যে নতুন-পুরনোর বিভাজন দেখছে, তারা আসলে নিজেদের সময় নষ্ট করছে!’’ ব্যাখ্যাও দিলেন খোলসা করে, ‘‘যে দিন তৃণমূল করা শুরু করেছিলাম, সে দিন মমতাদির আঁকা ঘাসের ওপর জোড়াফুল নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলাম। সে দিনও দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর নাম ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজও তিনিই আমাদের নেত্রী। আর প্রতীক সেই জোড়াফুল। তাই আমার কাছে দলের কোনও বদল আসেনি।’’
বস্তুত, বক্সী যেমন মমতাকে ‘পার্মানেন্ট লিডার’ বলে মনে করেন, তেমনই বক্সীকেও দলের ‘পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে মেনে নিয়েছে গোটা দল। সে নতুন প্রজন্মই হোক বা পুরনো। মাস চারেক আগের কথা। বাজেট অধিবেশনে গমগম করছে বিধানসভার অন্দরমহল। মধ্য ফেব্রুয়ারির দুপুরে অধিবেশন শুরুর আগে আচমকা তৃণমূলের মন্ত্রী-বিধায়কদের ভিড় মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষের ঘরে। ঘরের বাইরে নাকাশিপাড়ার পাঁচ বারের তৃণমূল বিধায়ক কল্লোল খাঁকে বাঘমুন্ডি থেকে প্রথমবার জিতে আসা বিধায়ক সুশান্ত মাহাতো প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী ব্যাপার? মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে কি মুখ্যসচেতকের ঘরে কোনও বৈঠক হচ্ছে?’’ প্রবীণ কল্লোলের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘আরে, পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট এসেছে তো!’’ শুনে ঘরে ঢুকে সটান বক্সীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেললেন সুশান্ত। বক্সী তখন ব্যস্ত মহার্ঘ ভাতা থেকে শুরু করে বিরোধী দলের রাজনীতি— নানা বিষয়ের বিশ্লেষণে। একাই কথা বলে যাচ্ছেন। আর বাধ্য ছাত্রের মতো শুনছেন মুখ্যসচেতক নির্মল থেকে শুরু করে শশী পাঁজা, ব্রাত্য বসু, তাপস রায়, নির্মল মাজিরা।
কংগ্রেস ছেড়ে ১৯৯৮ সালে মমতা যখন তৃণমূল গঠন করেন, তখন থেকেই প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী বক্সী তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি। ২০১৫ সাল থেকে মুকুল রায়ের সঙ্গে দলের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তখন মুকুলকে সরিয়ে বিশ্বস্ত বক্সীর কাঁধে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন মমতা। সেই থেকে বক্সী যৌথ পদের দায়িত্ব পালন করেন টানা ছ’বছর। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে জয়ের পর পরই অভিষেককে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নিঃশব্দে সেই আসন ছেড়ে দেন বক্সী। আবার তিনি শুধুই রাজ্য সভাপতি। ২০২২ সালের শুরুতে নতুন করে দলীয় কমিটি গড়েন তৃণমূল নেত্রী। তখন রাজ্য সভাপতির সঙ্গে সর্বভারতীয় তৃণমূলের সহ-সভাপতির পদ দেওয়া হয় বক্সীকে।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূলে ‘নতুন’-এর উত্থান। দক্ষিণ কলকাতায় হোর্ডিং দিয়ে একটি সংগঠন ঘোষণাও করেছিল ‘নতুন’ তৃণমূলের। নিজের বেশ কয়েকটি জনসভায় নতুন তৃণমূলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অভিষেকও। শোনা যায়, নতুন তৃণমূলে স্বস্তিতে নেই অনেক দাপুটে প্রবীণ নেতা। মমতার মন্ত্রিসভার রদবদলে বা দলীয় দায়িত্বের বণ্টনে তার ছায়াও দেখতে পান কেউ কেউ। কিন্তু রাজ্য সংগঠনে বক্সীর জায়গা বদলায়নি। তিনি সব প্রজন্মের সঙ্গেই ‘মানানসই’। তৃণমূলের ২৫ বছরের রাজনীতিতে বহু উত্থান-পতন দেখেছেন বক্সী। মুকুলকে দেখেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরিণতি দেখছেন। দেখেছেন পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তৃণমূলের একদম প্রথম প্রজন্মের একেবারে প্রথম সারির নেতার নিঃশব্দে সরে যাওয়া। তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনে নয়-নয় করে ছ’জন সভাপতি হয়েছেন গত ২৫ বছরে। সোনালি গুহ, বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কুদেব পন্ডা, অশোক রুদ্র, জয়া দত্ত থেকে তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। যুব সংগঠনের সভাপতি পদেও কম মুখ বদলায়নি। সঞ্জয় বক্সী থেকে মদন মিত্র, শুভেন্দু অধিকারী থেকে সৌমিত্র খাঁ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সায়নী ঘোষ। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে মুকুল থেকে অভিষেক। ২৫ বছর তো কম কথা নয়! মমতা (যে পদেই থাকুন, তিনি সর্বদাই সকলের উপরে) ছাড়া আর যিনি একই পদে এত দিন রয়ে গিয়েছেন, তিনি বক্সী।
এই ‘বক্সীরহস্য’-এর কারণ কী?
প্রথম এবং প্রধান কারণ— শর্তহীন আনুগত্য। দলীয় আনুগত্যের পাশাপাশিই নেত্রীর প্রতিও আনুগত্য। তিনি কখনও গোষ্ঠীলড়াইয়ে জড়াননি। দ্বিতীয়, রাজনৈতিক সততা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। কিন্তু দলে তাঁর কোনও ‘নিজের লোক’ সে ভাবে নেই। অনেকে বলেন, সেই কারণেই বক্সী খানিক দুর্মুখও বটে। সেই কারণে তাঁর কাছে দলের নেতা-কর্মীরা ‘অন্যায্য’ আব্দার করতে ভয় পান। জানেন, বক্সী দুটো ক়ড়া কথা বলতে পিছপা হবেন না। তৃতীয়, পদের মোহ না-থাকা।
যে কোনও অবামপন্থী দলের মতোই তৃণমূলেও গোষ্ঠীলড়াই রয়েছে। কিন্তু বক্সী কখনও কোনও লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন বলে শোনা যায়নি। নেত্রী তাঁকে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালন করেছেন নিঃশব্দে। তবে ‘মুখরা’ বক্সীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ‘ব্যবহার’ নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। সেই অভিযোগ কানে গিয়েছে মমতারও। কিন্তু তার পরেও বিশ্বস্ত, অনুগত বক্সী তাঁর আসনে থেকে গিয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কারণ, মমতা থেকে অভিষেক— নেতৃত্বের নির্দেশই তাঁর কাছে শেষকথা। ভারসাম্যের রাজনীতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁকে ২৫ বছর ধরে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন তৃণমূলের আদিনেতারা। এক প্রবীণ বিধায়কের কথায়, ‘‘নতুন হোক বা পুরনো, সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা রয়েছে বক্সীর। ওর বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। তাই দিদিও ওকে বদলানোর কথা কোনও দিন ভাবেননি।’’
কংগ্রেসি রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছাত্র পরিষদ করতেন। তার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকরি। চাকরিজীবনেও দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু মমতা নতুন দল গঠন করার সময় ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। নেত্রীর নির্দেশেই ২০০১ সালে বিষ্ণুপুর পশ্চিম (অধুনাবিলুপ্ত) বিধানসভা থেকে ভোটে লড়েন। প্রথম বারেই বিধায়ক। আবার ২০০৬ সালে নেত্রীর নির্দেশেই বিষ্ণুপুর পশ্চিম ছেড়ে চৌরঙ্গিতে জনপ্রিয় মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী। সে বার তৃণমূল মাত্র ৩০টি আসন পেলেও জয়ী হয়েছিলেন বক্সী। ২০১১ সালে নবগঠিত ভবানীপুর বিধানসভা থেকে জিতে মমতার প্রথম সরকারের পূর্ত ও পরিবহণ মন্ত্রী হন। কিন্তু ওই বছরই অগস্টে মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। নভেম্বর মাসের উপনির্বাচনে মমতার দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে চলে যান সংসদে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বার সাংসদ হলেও ২০১৯ সালে আর প্রার্থী হতে চাননি। সভাপতির ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে ভোটে লড়ার জন্য জোরাজুরি করেননি মমতা। বদলে ২০২০ সালে তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠান।
কিন্তু মুখে যা-ই বলুন, পোড়খাওয়া রাজনীতিক বক্সী জানেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল আসাই নিয়ম। সেই জন্যই কি নিজে থেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেককে রাজ্য সংগঠনেরও সভাপতি পদে বসাতে? স্বয়ং বক্সী এর জবাব দেননি। তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন, তাঁরা বলছেন, ‘‘এটা তো ঠিকই যে, বক্সীদার বয়সটাও হয়েছে। আর সকলকেই তো কোথাও না কোথাও থামতে হয়।’’
বক্সীর থামতে চাওয়ার ইচ্ছা ফলবতী হবে? ‘অনুগত’ বক্সী সম্ভবত নিজেও জানেন না। জানেন তৃণমূলের এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম ‘পার্মানেন্ট লিডার’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy