উত্তরবঙ্গে তখনও এত ভিড় জমেনি। মনে আছে, এক শীতের ভোরে ঘুমচোখে কুয়াশাঢাকা রাস্তা ধরে জিপে করে ফরেস্টের দিকে যাওয়া, ফরেস্ট বাংলোর অদূরে জিপ রেখে বড়-বড় বাস্কেট নিয়ে নেমে পড়া। শালে ঘেরা জঙ্গলের ভিতরে ঘাসজমি দেখে চাদর বিছিয়ে দেওয়া হল। ক্রমশ সেই চাদর ভরে উঠল বেতের বাস্কেটে। মা-মামিমাদের সেই বাস্কেট থেকে একে একে বেরোতে শুরু করল সিদ্ধ ডিম, মার্মালেডের শিশি, গোল-গোল বান রুটি। শিলিগুড়িতে তখন মাখন আর চিনির সুবাসে ভরপুর এক ধরনের বান পাওয়া যেত। সেই বান আর ডিম সিদ্ধ ধরিয়ে দেওয়া হল বাচ্চাদের হাতে। বড়দের জন্য লুচি আর শুকনো আলুর দম। প্রাতরাশ সেরে জঙ্গলের শুকনো কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলে শুরু হল মাংস কষা। আর অন্য দিকে ফরেস্ট বাংলো থেকে নিয়ে আসা হল পাম্প দেওয়া কেরোসিনের স্টোভ, ওতে হবে ভাত রান্না। শালবনে সেই কেরোসিনের গন্ধমাখা শীতের অলস সকালই ছিল জীবনের প্রথম পিকনিক।
সে দিন হেঁশেল ছেলেদের হাতে, মা, মামিমাদের রান্না থেকে ছুটি। সবুজের মাঝে আলুনি সে রান্নাও শালপাতার বুকে যেন এক মায়াবী দুপুর তৈরি করত। চুলে পাক ধরতে ধরতে সেই বনভোজনের স্বাদও কত পাল্টেছে। তবে সব পিকনিকেই স্থান-কাল-পাত্রটা জরুরি। পিকনিকের শুরুই প্ল্যানিং-পর্ব থেকে।
কখন, কোথায়, কবে?
কোথায়, কবে পিকনিক, কে কে যাবে, মেনু কী... ঠিক করতে করতে গোটাকতক চপ, কাটলেট, ডেভিল সাবড়ে দেওয়াই যে রেওয়াজ। টেনিদার বনভোজনে যেমন বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা থেকে লিস্টি এসে দাঁড়াত খিচুড়ি (সঙ্গে রাজহাঁসের ডিম), আলু ভাজা, পোনা মাছের কালিয়া, আমের আচার, লেডিকেনিতে। তা শেষ পর্যন্ত কী জুটল না জুটল, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু টেনিদা, হাবুল, প্যালা, ক্যাবলাদের মতো পিকনিকের একটা লিস্টি করতে হবে তো! শীতকালের সপ্তাহান্ত বলে কথা। লোকজন জুটিয়ে, চাঁদা কেটে, বাসনকোসন বোঝাই করে বনভোজনে না গেলে চলে! ফেলুদা পর্যন্ত কি না রহস্য সন্ধান করতে করতে পিকনিক সেরে এসেছে হাজারিবাগের রাজারাপ্পার জঙ্গলে। সুতরাং শীতকাতুরে বাঙালি একদিন ভোরে বাক্সপ্যাঁটরা, লোকলশকর, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পিকনিকে না গেলে যে শীতকালই বৃথা।
বাগানবাড়ি নাকি নদীর ধারে...
বনভোজনের স্থান-নির্বাচন কমসম ব্যাপার নয়। ‘চোখের বালি’র দমদমের বাগানবাড়ির মতো কোনও সাজানো বাড়ি নাকি উস্রি নদীর ধারে... কোথায় যে চড়ুইভাতি হবে, তা নিয়ে জল্পনারও শেষ নেই। তবে প্রথম পিকনিক শুরু হয়েছিল ঘরের মধ্যেই। ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণির হাত ধরে ক্রমশ তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময়ে অভ্যাগতরাই সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন খাবার আর পানীয়। ফরাসি বিপ্লবের পরে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ইংল্যান্ডে চলে যান ফরাসি অভিজাতরা। আর তাঁদের সঙ্গেই সে সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে পিকনিক কালচার। আসলে ফরাসি শব্দ ‘পিক’ মানে নেওয়া আর ‘নিক’ অর্থাৎ অল্প পরিমাণের সঙ্গতেই ক্রমশ ভরে উঠতে থাকে পিকনিকের ভাঁড়ারঘর। ১৮০১ নাগাদ পিকনিক সোসাইটিও তৈরি হয় লন্ডনে।
তবে সাহেবসুবোদের হাত ধরে পিকনিক এ দেশে এসেছে, তা বলা যাবে না। কারণ মহাভারতের সময়েও দেখা যায় বনভোজনের চিত্র। কৃষ্ণ, বলরাম ও অর্জুনের বনভোজনের তালিকায় রয়েছে হরিণ ও তিতির পাখির মাংস আর নানা ফল। এই মাংস খাওয়ার চল শুরু কিন্তু শিকার করা থেকে। আগে যেমন রাজারাজড়ারা শিকারে যেতেন, যা শিকার হত, তাই বনের মধ্যে পুড়িয়ে-ঝলসে খেতেন, পরে পরাধীন ভারতে সাহেবরাও বন্দুক উঁচিয়ে জঙ্গলে যেতেন। তাই অনেক কাল পর্যন্ত পিকনিকে যাওয়ার সঙ্গে শিকারের চিত্রও জড়িত ছিল। তবে ক্রমশ মানুষ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রতি সতর্ক হওয়ায় বন্ধ হয়েছে শিকার।
সেখানে গানের লড়াই, মেমারি গেম, ব্যাডমিন্টন, সাঁতারের মতো কত ইনডোর, আউটডোর গেম সঙ্গী হয়ে উঠেছে এই আলো-হাওয়ার দিনে। কারও আবার একটা বই-ই সঙ্গী সে দিন, যেমন ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ অশ্বত্থগাছের নীচে শতরঞ্চি বিছিয়ে, ইংরিজি পেপারব্যাকের ডিটেকটিভ বই বার করে বসে পড়েন নীলিমা দেবী। শুধুই কী বই, মনোরঞ্জনের জন্য সে যুগে গ্রামোফোন, রেকর্ডও মাথায় করে নিয়ে যেতেন পরিচারকেরা। তবে এখনকার মতো বক্সের তারস্বরে চিৎকার নয়, বরং লাইট মিউজ়িক মেজাজ তৈরি করে দিত পিকনিকের। কখনও আবার সুরের তালে হাতে-হাত, দু’-এক পা নাচও চলত। তার সঙ্গে থাকত দুধ-সাদা টেবলক্লথ, রুপোর কাটলারি, ক্রিস্টাল গ্লাস, ফিঙ্গার বোলস... আরও কত কী! ঘাসের উপরে বিছিয়ে দেওয়া হত সাদা টেবলক্লথ। তার উপরে বেতের ঝুড়ি থেকে ফল, শুকনো খাবার, পানীয় সাজানো হত একে একে। গাছের পাতা সরিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ-ছায়ার খেলা চলত সেই চাদরে। অলস দুপুর কাটত প্রকৃতির মাঝে।
জ্যোৎস্নালোকে পিকনিক
দিনের আলোয় বনভোজনের মতো মুনলাইট পিকনিকের আবেদনও কম ছিল না। মূলত কোনও ক্যানাল বা নদীর ধারেই এই ধরনের পিকনিকের আয়োজন করা হত। জেনিফার ব্রেনানের স্মৃতিচারণা ও কুকবুকে পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে এ দেশে সাহেবসুবোদের মধ্যে মুনলাইট পিকনিকের চল ছিল। চাঁদের আলোয় সাহেব-মেমসাহেবরা সুইমসুট পরে নেমে যেতেন নদী বা জলাশয়ে সাঁতার কাটতে। এ দেশের গরমেই মূলত এ ধরনের পিকনিক হত। ঠান্ডা জলে জ্যোৎস্না মেখে উঠে এলে শুরু হত হালকা গানের সঙ্গে নাচ। তার পরে নৈশভোজের আয়োজনে থাকত শুকনো খাবার, সঙ্গে নানা রকমের পানীয়। অনেক সময়ে কোনও পরিচিত মারফত রেল ইঞ্জিনের কামরাও সেজে উঠত পিকনিকের আয়োজনে। বনভোজনের স্থান-কাল-পাত্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই মেনু।
মেনুতে কী?
এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’-এর পিকনিক বাস্কেট থেকে যেমন বেরিয়ে পড়ে কোল্ড হ্যাম, স্ট্রবেরিজ় অ্যান্ড ক্রিম, স্যান্ডুইচ, স্কোনস। আবার জেনিফার ব্রেনানের কুকবুকে পিকনিকের মেনুতে উঁকি দেয় স্টিমরোলার চিকেন, পট্যাটো কাটলেটস, কোল্ড হ্যাম, চিকেন ক্রকেটের মতো শুকনো খাবার। তাই পিকনিক শুরুর দিনগুলোয় গেলে দেখা যাবে, বাঙালির বনভোজনেও খানিকটা সাহেবি কায়দার খাবারই সঙ্গত করত। বনভোজনের মেনু ঠিক করে দিতে লীলা মজুমদার যেমন লিখেছেন, “দুপুরের জন্য দুটো মুরগি আগের দিন রোস্ট করে রাখলে। তার সঙ্গে আলু রোস্ট করলে, মটর সেদ্ধ করলে। একটা করে ডিম শক্ত করে সেদ্ধ করে নুন মাখিয়ে লাল করে ভেজে দিলে... বিকেলের জন্য একটা প্লেন বড় ফলের কেক নিলে... স্কচ শর্টব্রেডও নিতে পারো।” সেখানেই আবার লুচি, মাছের চপ, মাংসের বড়ার মতো দেশি খাবারের নামও রয়েছে। খাবার সঙ্গে নিয়ে গেলে শুকনো খাবারই ভাল। তবে চড়ুইভাতিতে গিয়ে রাঁধলে মাংস-ভাত, পোলাও-কাটলেট থেকে খিচুড়ি-ডিমভাজাও থাকতে পারে। আর বনভোজনের দিন রাঁধুনি হোক না হোক, প্রকৃতির মাঝে উন্মুক্ত হেঁশেলে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার। যে কোনও আকারে আলু কাটা যেমন সঙ্গত, আলুনি রান্নাও সে দিন স্টার পারফর্মার। মাছের কালিয়ার জায়গায় মাছের হালুয়া হলেও ক্ষতি নেই।
পিকনিকের প্রাপ্তি শুধু উদরের স্ফুর্তিতেই সীমিত নয়, তার চেয়েও বেশি। ‘চোখের বালি’তে বনভোজনে বিনোদিনী যেমন মন খুলেছিল বিহারীর কাছে, একটা দিন নদীর জলে পা ডুবিয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছে মনের আগল খোলা যায়। নরম ঘাসে খালি পায়ে একা হাঁটা যায়, একদিনের জন্য চিরশত্রুও পাতে এক টুকরো মাংস বেশি দিয়ে যায়। বুড়ো হাড়ে যুবাদের দলে নাম লিখিয়ে ক্রিকেট খেলা যায়। নিদেনপক্ষে চোখে সবুজ নিয়ে, কষা মাংসের গন্ধ সঙ্গী করে গল্পগুজবে হারিয়ে যাওয়া যায় অবেলার ভোজের অপেক্ষায়। ফিরতি পথে কমলালেবুর রং জানান দেয়, আজ মনেও কতটা রং লেগেছে। রুটিন জীবনের মাঝে এমন একটা অগোছালো বেঠিক দিনও থাক না হয়...
মডেল: ঐশ্বর্যা সেন, অলকানন্দা গুহ, রোহন ভট্টাচার্য, আরিয়ান; ছবি: চিরঞ্জীব বণিক; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্তা; হেয়ার: সুস্মিতা বেরা; পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ়: ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল, গড়িয়াহাট; পিকনিকস্পট:অঞ্জলিকুঞ্জ (বারুইপুর)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy