শিক্ষক সুজিত দাস। ফাইল চিত্র।
আবেগের কাছে হার মানল নিয়ম।
‘স্যার, আমাদের ছেড়ে যাবেন না’ এই দাবিতে বৃহস্পতিবার ঘণ্টাদুয়েক বারাসতের কদম্বগাছি সর্দারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেরাও করল কচিকাঁচারা। মিছিল করলেন গ্রামবাসী। অভিভাবকেরা হুমকি দিলেন, ‘স্যার’ চলে গেলে ওই স্কুলে ছেলেমেয়েদের আর পাঠাবেন না।
যাঁর বদলি রুখতে এই আন্দোলন, তিনি সুজিত দাস। ১০ বছর আগে এই স্কুলে যোগ দেন। এক বছর ধরে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গ্রামবাসীদের বিপদে-আপদে পাশেও দাঁড়াচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার ছোট জাগুলিয়ার বহেরা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল সুজিতবাবুর। কিন্তু তাঁর জন্য কচিকাঁচা এবং গ্রামবাসীদের আবেগ দেখে বিহ্বল সুজিতবাবু শেষমেশ ঘোষণা করে দিলেন, তিনি পুরনো স্কুল ছেড়ে যাবেন না। তবে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নয়, থেকে যাবেন আর পাঁচ জন শিক্ষকের মতোই।
হাসি ফুটল স্কুলের কচিকাঁচা এবং তামাম গ্রামবাসীর। জয়ধ্বনি উঠল সুজিতবাবুর নামে। সুজিতবাবুকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের এই টানাপোড়েনের ঘটনাটি জানেন রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “পদোন্নতি না নিয়ে ওই শিক্ষক পুরনো স্কুলে থাকতেই পারেন। অসুবিধা নেই। দেখতে হবে, স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত যেন ঠিক থাকে।”
শুধু ছাত্রছাত্রীদের কাছেই নন, গত চার বছরে কদম্বগাছির সাধারণ গ্রামবাসীদের কাছেও বড় ভরসার মানুষ হয়ে দাঁড়ান সুজিতবাবু। গ্রামবাসীরা জানান, সুজিতবাবু ব্লক অফিস এবং পঞ্চায়েতে ধরনা দিয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ এনেছেন। সর্বশিক্ষা অভিযানের টাকায় স্কুলে ঘর বানিয়েছেন। স্কুল চত্বরে নোংরা পড়ে থাকলে নিজের হাতে পরিষ্কার করেছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের প্রয়োজনে নিজে হাতে নানা আবেদনও লিখে দিয়েছেন। এমনকী, গরিব ঘরের বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে স্কুলে এনে পঠনপাঠনের ব্যবস্থাও করেছেন।
এমন শিক্ষককে যে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ বদলির নির্দেশ দিয়েছে, এক সপ্তাহ আগেই তা জানতে পেরেছিলেন গ্রামবাসীরা। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল আন্দোলন। সেই সময়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মীনা ঘোষ জানিয়েছিলেন, এমন দায়িত্ববান শিক্ষকদের অন্য অনেক স্কুলে আরও প্রয়োজন। তেমন একটি স্কুলে এমন শিক্ষক গেলে সেই স্কুলটিরও উন্নতি হবে। কিন্তু গ্রামবাসীরা মানতে পারেনি।
প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের নির্দেশেই এ দিনই কদম্বগাছির ওই স্কুলটিতে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দিতে আসেন মাধবী রায়। সুজিতবাবুও স্কুলে যান মাধবীদেবীকে সমস্ত কাজকর্ম বুঝিয়ে স্কুল ছাড়তে। স্কুলে গিয়ে এ কথা জানতে পেরে অভিভাবকদের খবর দেয় ছাত্র-ছাত্রীরাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে জড়ো হন কয়েকশো অভিভাবক ও গ্রামবাসী। সর্দারহাটির শ-পাঁচেক পরিবার ছাড়াও রাস্তাপাড়া, সাজপাড়া, নয়ডাপাড়া এলাকার মানুষ সামিল হন। সকলে মাধবীদেবীকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। শুরু হয় বিক্ষোভ। স্কুলের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
শেষমেশ বিক্ষোভ সামাল দিতে বেরিয়ে আসতে হয় সুজিতবাবুকেই। তিনি বলেন, “হয়তো নতুন স্কুলে গেলে আমি উঁচু পদ, বেশি বেতন পেতাম। কিন্তু আপনাদের ভালবাসার কাছে হার মানলাম। যিনি এখানে এসেছেন, তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবেই কাজ করবেন। আমি এই স্কুলে সাধারণ শিক্ষক হিসেবেই কাজ করব।’’
সুজিতবাবুর প্রতি গ্রামবাসীদের এই ভালবাসা দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েন মাধবীদেবীও। সুজিতবাবু অবশ্য নিজের কর্তব্য থেকে সরেননি। বিক্ষোভ-মিছিলে কয়েক ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে এ দিন। আর সময় নষ্ট করতে চাননি। ছাত্রছাত্রীদের নির্দেশ দেন, “ক্লাস বন্ধ করা যাবে না। সব ছাত্র-ছাত্রীদের ঘরে ঘরে গিয়ে ক্লাস শুরু করতে বলছি।’’
স্কুলে ঘণ্টা পড়ে। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ফেরে। শুরু হয় পঠন-পাঠন। ঠিক আগের মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy