Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
রাস্তা আটকে চলছে ইমারতি জিনিসের রমরমা ব্যবসা

লাইসেন্স-ঝক্কিতে বেপরোয়া বেআইনি যান

দুর্ঘটনায় পথচারীর প্রাণ যায়। প্রতিবাদে বড় জোর জনতা বিক্ষোভ দেখায়। গাড়ি ভাঙচুর করে। রাস্তা অবরোধ করে। পুলিশ এসে রক্ত ধুয়ে দিয়ে মৃতদেহ মর্গে পাঠায়। কিন্তু রাস্তা দখল করে বেআইনি গাড়ি পার্কিং, রাস্তার পাশে বালি-পাথর-ইট রেখে ব্যবসা বন্ধ হয় না। বন্ধ হয় না রাস্তার দখলদারী। লাইসেন্স-বিহীন গাড়ি চালালেও চালক ধরা পড়ে না। সমস্যার সুরাহা কোন পথে, জানেন না বসিরহাটবাসী।

প্রশাসনের নিষেধের তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় এ ভাবেই ফেলে রাখা হয় বালি। ন্যাজাট রোডের ছবি।

প্রশাসনের নিষেধের তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় এ ভাবেই ফেলে রাখা হয় বালি। ন্যাজাট রোডের ছবি।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০১:৪০
Share: Save:

দুর্ঘটনায় পথচারীর প্রাণ যায়। প্রতিবাদে বড় জোর জনতা বিক্ষোভ দেখায়। গাড়ি ভাঙচুর করে। রাস্তা অবরোধ করে। পুলিশ এসে রক্ত ধুয়ে দিয়ে মৃতদেহ মর্গে পাঠায়। কিন্তু রাস্তা দখল করে বেআইনি গাড়ি পার্কিং, রাস্তার পাশে বালি-পাথর-ইট রেখে ব্যবসা বন্ধ হয় না। বন্ধ হয় না রাস্তার দখলদারী। লাইসেন্স-বিহীন গাড়ি চালালেও চালক ধরা পড়ে না। সমস্যার সুরাহা কোন পথে, জানেন না বসিরহাটবাসী।

বিভিন্ন গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় স্পষ্ট হল, রাস্তা আটকে ইমারতি দ্রব্য কিংবা অন্য ব্যবসা বন্ধ যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং চালকের লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা। গত কয়েক মাসে বসিরহাট মহকুমায় দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যায় এগিয়ে মোটর বাইক আরোহীরা। প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে মোটর বাইক চালানোর সময়ে। লরি, ম্যাটাডোর কিম্বা বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগাই যার কারণ। এঁদের আবার বেশিরভাগ লাইসেন্স-বিহীন ভাবে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনার পরে বিমার টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও পরিবারের লোকেরা সমস্যায় পড়েছেন।

মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৮৬১ সালের ১ জানুয়ারি ৩৫২ বর্গ মাইল এবং ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৪৬ জন নাগরিক নিয়ে বসিরহাট মহকুমা গঠিত হয়। ওই সময়ে বসিরহাট মহকুমায় ৪৭৩টি গ্রাম এবং ৫১ হাজার ৬০৩টি বাড়ি ছিল। আজ ২০১৫ সালে বসিরহাটের ১০টি ব্লকে পঞ্চায়েতের সংখ্যা ৯০টি। মহকুমার ৯টি থানা এলাকায় ৬৬০টি মৌজায় রয়েছে ১১৮৪টি গ্রাম। ১,৮০৫.৮৯ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকায় ২৩ লক্ষের উপরে লোকের বাস। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার কথা ভেবে ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল বাদুড়িয়া, টাকি এবং বসিরহাটে তিনটি পুরসভা গঠন করা হয়।

বসিরহাট মহকুমার ৯টি থানা এলাকায় মোটর বাইক বিক্রি করেন ৪ জন ডিলার। সাব ডিলারের সংখ্যা ২০। শহরে ৮টি কাউন্টার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ি বিক্রি হয়। এ ছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি ৪ চাকার গাড়ির শো-রুম। এই সব কাউন্টার থেকে প্রতি মাসে এক হাজারের উপরে মোটর বাইক এবং শতাধিক চার চাকার গাড়ি বিক্রি হয়। কয়েক জন মোটর বাইক বিক্রেতা জানালেন, ধরা যাক কেউ সন্দেশখালি কিংবা সামশেরনগরের বাসিন্দা। তিনি একটা মোটর বাইক কিনেছেন। তাঁর পক্ষে দালাল চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিংবা না করেও একশো কিলোমিটারের বেশি পথ উজিয়ে একাধিকবার বারাসাতে মোটর ভেহিকল্‌স দফতরে গিয়ে গাড়ির কাগজ, নম্বর কিংবা লাইসেন্স করানো অনেক সময়েই সম্ভব হয় না। তা ছাড়া, গাড়ির কাগজপত্র এবং লাইসেন্স করতে ৩-৪ মাসের বেশি সময় লেগে যায়। যার ফলে মোটর বাইক ক্রেতাদের একটা বড় অংশের মধ্যে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বাড়ে। গাড়ি চালানোর পরীক্ষা না দেওয়ায় নিয়মকানুন ভাল মতো জেনে ওঠেন না। এই অবস্থায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। বসিরহাট মহকুমায় অবিলম্বে পরিবহণ দফতরের পূর্ণাঙ্গ অফিস হওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই বাইক বিক্রেতারা।

মোবাইল কানে চালক।

এক বছর তিন মাস আগে বসিরহাট মহকুমাশাসকের দফতরের সামনে পরিবহণ দফতর হয়েছে। কিন্তু সেখানে কেবল গাড়ির ট্যাক্স জমা নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ হয় না। এ বিষয়ে মহকুমার অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক অভিজিত্‌ চক্রবর্তী বলেন, “সঠিক পরিকাঠামো এবং কর্মীর অভাবে রেজিস্ট্রেশন এবং লাইসেন্স করা সম্ভব হচ্ছে না। চেষ্টা করা হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দু’টি বিষয়ে কাজ শুরু করার।” তাঁর মতে, পূর্ণাঙ্গ অফিস চালু হলে একজন চালকের পক্ষে লাইসেন্স করা কতটা জরুরি এবং লাইসেন্স কিংবা গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখা কতটা প্রয়োজন, তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

এ তো গেল গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং লাইসেন্সের ব্যপার। কিন্তু রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ি এবং রাস্তা আটকে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসা বন্ধের কী হবে? যানজট আটকাতেই বা পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? এ ক্ষেত্রে পুরসভার ভূমিকাই বা কী?

বসিরহাট থানার আইসি গৌতম মিত্র বলেন, “ত্রিমোহনী, চৌমাথা, ৭২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড, টাউনহল, বসিরহাট স্টেশন রোড, কলেজ, রেজিস্ট্রি অফিস মোড়, বোটঘাট, হরিশপুর, আমতলা, দণ্ডিরহাট-সহ শহরের বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় রাস্তায় পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল-কলেজের সামনে সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশ রাখা হচ্ছে। রাস্তার পাশ থেকে ইমারতি দ্রব্য সরানোর জন্য পুরসভা এবং পূর্ত দফতরকে বলার পাশাপাশি পুলিশের পক্ষে অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কেস দেওয়া হচ্ছে। পোস্টার সেঁটে মানুষকে রাস্তা আটকে পার্কিং বা ব্যবসা না করার জন্য সচেতন করা হচ্ছে বলেও জানান আইসি। ইতিমধ্যে হেলমেট ছাড়া এবং লাইসেন্স-বিহীন প্রায় ৫০টি গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে মোটর ভেহিকল্‌স আইনে কেস দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন গৌতমবাবু।

বসিরহাট পুরসভার উপ পুরপ্রধান অমিত দত্ত বলেন, “রাস্তার পাশে অবৈধ পার্কিংয়ের ব্যবসা বন্ধের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শহর আলোকিত করতে বিভিন্ন এলাকায় হাইমাস আলো লাগানো হচ্ছে। ইছামতী সেতুর উপরেও আলো লাাগানো হয়েছে।”’

কিন্তু এ সবের পরেও কি দুর্ঘটনা রোখা যাচ্ছে?

সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে বাড়তি তত্‌পরতা দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি যে কে সেই। রাস্তার পাশে ব্যবসা, পার্কিং পুরোপুরি বন্ধ হয় না কখনওই। অভিভাবকেরাও অল্পবয়সী ছেলেদের মোটর বাইক কিনে দিচ্ছেন দেদার। মফস্‌সল অঞ্চলে সাইকেল না চালিয়ে হয় তো উপায় নেই। কিন্তু যে ভাবে প্রচুর সংখ্যক অল্পবয়সীদের হাতে মোটর বাইক চলে যাচ্ছে, তা সত্যিই উদ্বেগের।

আর এ সব কারণে একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে। স্বরূপনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হাসানুর মোল্লার কথাই ধরা যাক। বাবার দেওয়া নতুন সাইকেল চালিয়ে মামার বাড়ি যাচ্ছিল সে। স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া সেতুর মুখে রাস্তা পাশে ফেলে রাখা বালি-পাথরের জন্য পথ সংকীর্ণ হয়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, লাইসেন্স-বিহীন এক যুবকের ছোট গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগার পরে উল্টো দিক থেকে আসা একটি ইট-বোঝাই লরি ওই কিশোরকে পিষে দিয়ে যায়। ঘটনার পরে দফায় দফায় রাস্তা অবরোধ হয়। বালি-পাথর সরানো হবে বলে পুলিশ প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্ত ওই পর্যন্তই। রাজনৈতিক দাদাদের দাক্ষিণ্যে ব্যবসা দিব্যি চলছে, এমনটাই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের।

দণ্ডিরহাটের মনসুর মোল্লা, রাজনগরের সন্দীপ মণ্ডল, গয়ড়া গ্রামের কুদ্দুস আলি, পঙ্কজ বাছাড়, আলাউদ্দিন শেখ, সাহিদা বিবি, আব্দুর রহমান মণ্ডল, স্বপনকুমার ঘোষ, মিজানুর মোল্লা, তরুণকুমার ঘোষ, জগদীশ ঘোষ, আনোয়ার হোসেন গাজি, দাসীবালা দাস দুর্ঘটনায় সাম্প্রতিক কাতে মৃত্যুর তালিকাটা দীর্ঘ।

দিন কয়েক আগে মাধ্যমিকের দুই পরীক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এখনও শোকগ্রস্ত লক্ষণকাটি গ্রাম। ঘটনার পরে মৃত-আহত ছাত্রদের বাড়িতে যান সাংসদ ইদ্রিশ আলি। গ্রামের মানুষ সাংসদকে জানান, গাড়ি কিনে অনেকেই বাড়ির সামনে রাস্তার উপরে রাখছে। রাস্তা আটকে ইমারতি ব্যবসা চলছে। এ সবের জন্য বাড়ছে দুর্ঘটনা। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকছে ইমারতি দ্রব্য-বোঝাই গাড়ি। লাইসেন্স-বিহীন গাড়িও বেড়ে চলেছে। ইদ্রিশ বলেন, “রাস্তার উপরে যাতে গাড়ি পার্কিং না করা হয় এবং রাস্তা আটকে ইমারতি ব্যবসা যাতে বন্ধ করা যায়, সে ব্যাপারে প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে।” আশার কথা শুনিয়ে বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেনও। তিনি বলেন, “রাস্তা আটকালে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে। গাড়ির কাগজ করতে আর বারাসাতে যেতে হবে না। আশা করছি আগামী মার্চ মাসের মধ্যে পরিকাঠামোগত সব সমস্যা মিটিয়ে বসিরহাটে পরিবহণ দফতর থেকে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হবে।”

—নিজস্ব চিত্র।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE