রাজা দত্ত
শেষ পর্যন্ত রাজাই কিনা বেপাত্তা!
মুকুট ছিল না বটে। তবু নিজেকে রাজাই ভাবতেন তিনি। ভাবার কারণও ছিল যথেষ্ট। একটা সময় হালিশহরে রাজা দত্তের কথাই ছিল শেষ কথা।
হালিশহর পুরসভার উপ-পুরপ্রধান রাজা (দেবাশিস দত্ত)। ছিলেন শহর যুব তৃণমূলের সভাপতিও। এক সময় তৃণমূলের ‘নম্বর-টু’ মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অন্যের জমি দখল, জলা ভরাট করে বহুতল নির্মাণ, গঙ্গা থেকে বেআইনিভাবে বালি তোলা, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলা— এমন হাজারো অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু মাস কয়েক আগেও হালিশহরে তাঁর বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দ করার কেউ ছিল না।
মাসখানেকের বেশি সময় ধরে সেই রাজা দত্তই শহর ছাড়া। পুরসভায় যাচ্ছেন না। যে বাড়িগুলিতে তিনি থাকতেন, সেখানেও তাঁর কোনও খোঁজ নেই। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জনরোষের ফলে কার্যত এলাকায় বাস করা তাঁর পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। তাঁর বাড়িতে হামলা পর্যন্ত হয়েছে। এক রাতের পর থেকে তার কোনও খোঁজ মিলছে না।
কোথায় গেলেন তিনি? নাহ, পার্টির কেউ তাঁর কোনও খোঁজ দিতে পারছেন না। জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়েছে, দিন কয়েকের মধ্যেই পুরসভার উপ-পুর প্রধানের পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে বসানো হবে।
নিজের রাজ্যপাট নিয়ে দিব্যি ছিলেন রাজা। কিন্তু, গত বিধানসভা ভোটে একটি বিতর্কে জড়ানোর পরে তার নাম সামনে আসে।
হালিশহরেরই বাসিন্দা দেবশ্রী ঘোষ কোলের শিশুকন্যা সায়ন্তিকাকে নিয়ে ভোট দিতে এসেছিলেন বাপের বাড়িতে। ভোটের আগের রাতে তাঁদের বাড়িতে হামলা করে জনা আটেক দুষ্কৃতী। লাঠি ও বাঁশ দিয়ে পেটানো হয় দেবশ্রী ও তাঁর বাবা টিটু সমাজপতিকে। রেহাই পায়নি ছোট্ট সায়ন্তিকাও। হাত মুচড়ে দেওয়া হয় তার। বাঁশের ঘা পড়ে পায়েও। হুমকি দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা বুথমুখো না হন। যদিও তার পরে ভোট দিতে গিয়েছিলেন দেবশ্রীরা। অভিযোগ ওঠে রাজার বাহিনীই সে রাতে দেবশ্রীদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। ঘটনার সঙ্গে তৃমমূল নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু, দেবশ্রীর সাহস ভরসা যুগিয়েছিল অনেককেই। এই সময় অনেকেই রাজার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। এমনকী, একটি খুনের ঘটনাতেও নাম জড়ায় রাজার। যদিও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেনি।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজের বদনাম ঘোচানোর জন্যই রাজা গত দেড় বছরে হালিশহরে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু, তাতেও তাঁর ভাবমূর্তি বিশেষ উজ্জ্বল হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের শাকরেদদের কাছ থেকেই কার্যত ধাক্কা খেতে হল তাঁকে।
একটা সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও পরে কিন্তু তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন মুকুল রায়। দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন মুকুল পুত্র, এলাকার বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়ও। কয়েক মাস আগে দল তাঁকে যুব তৃণমূলের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। তার পর থেকেই শাকরেদদের অনেকেই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে। শুভ্রাংশুকেও পাশে পাননি তিনি।
মাস তিনেক ধরে বেশ কিছু বাসিন্দা নিয়মিত টাকা ফেরত চেয়ে রাজার বাড়িতে তাগাদা শুরু করেছিলেন। অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নাম করে রাজা তাঁদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি পাননি কেউই। মাস দেড়েক আগে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন রাজা। এলাকার বাসিন্দারা সেই উৎসব শেষ মুহূর্তে বন্ধ করে দেন। বেশ কয়েক লক্ষ টাকা লোকসান হয় তাঁর। এর পরেই এক রাতে টাকা ফেরত চেয়ে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয় বেশ কিছু যুবক। তখন তাঁর পাশে কেউ ছিল না। এমনকী, ফোন করেও শাকরেদদের কাউকে পাশে পাননি তিনি।
তার পর থেকেই বেপাত্তা তিনি। বন্ধ মোবাইল ফোন। শুভ্রাংশু বলছেন, ‘‘আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন ওঁর কোনও যোগাযোগ নেই।’’ জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় বলছেন, ‘‘এমনটা চলতে পারে না। ২৪ ফেব্রুয়ারি দলের কোর কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে রাজা দত্তকে উপ-পুরপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তার জায়গায় অন্য কাউকে আনা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy