দলের গোষ্ঠীকোন্দলের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। —প্রতীকী ছবি।
ঘটনা ১: কালীপুজো উপলক্ষে হাড়োয়ার একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক উষারানি মণ্ডল এবং তাঁর স্বামী, তৃণমূল নেতা মৃত্যুঞ্জয়। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কিছু অনুগামী। অভিযোগ, ফেরার পথে তাঁদের উপরে হামলা চালায় এক দল দুষ্কৃতী। গুলি ছোড়া হয়। গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গাড়ি থেকে বিধায়ককে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে লোহার রড দিয়ে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ।
ঘটনা ২: বসিরহাট উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ‘সন্ধান চাই’ পোস্টার পড়েছিল তাঁরই বিধানসভা এলাকায়। বিধানসভা ভোটের পর থেকে এলাকায় বিধায়কের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ জানানো হয়েছে পোস্টারে। নীচে লেখা, ‘তৃণমূল কংগ্রেস সম্মানরক্ষা কমিটি।’
ঘটনা ৩: কালীপুজোর রাতে সন্দেশখালির তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতো ন্যাজাটের শিমুলআটি এলাকায় একটি পুজোর অনুষ্ঠান সেরে কানমারি এলাকায় নিজের বাড়িতে ফেরার সময়ে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয় বলে অভিযোগ।
সব ক্ষেত্রেই তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে বলে দলেরই অন্দরে মনে করছেন অনেকে।
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ঘটনায় তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের ছবি বেআব্রু হয়ে পড়ছে। ১৩ নভেম্বর বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হাড়োয়া বিধানসভার উপনির্বাচন। তার আগে দলের এই পরিস্থিতি তৃণমূল নেতৃত্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন সদ্য প্রয়াত বসিরহাটের সাংসদ নুরুল ইসলামের ছেলে শেখ রবিউল ইসলাম। তাঁর হয়ে প্রচার করা নিয়েও তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে দেগঙ্গা ব্লকের চাঁপাতলা পঞ্চায়েত এলাকায়। ভোট-প্রচারকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী এখানে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ।
বসিরহাটে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা অনেকে জানালেন, এখানে গোষ্ঠীকোন্দল যতটা না রাজনৈতিক কারণে, তার থেকে বেশি ভেড়ি, জমি দখলের জেরে। শেখ শাহজাহানের সময়ে শুধু তাঁর শাসন চলত এখানে। সমস্যা তৈরি হয়েছে সে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে। শাহজাহানের জন্য এত দিন যাঁরা মাথা তুলতে পারেননি, তাঁরাও এখন আসরে নেমে পড়েছেন। তবে এখানে শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দল হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে বলে জানালেন কর্মীদের একাংশ। এখন তা বেশি করে প্রকাশ্যে আসছে বলেই মত তাঁদের। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এখানে বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই স্থানীয় ভাবে শাসক শিবিরের দুই বা তার বেশি গোষ্ঠী রয়েছে।’’
হাড়োয়া সহ বসিরহাট মহকুমা জুড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল ইদানীং একাধিক বার প্রকাশ্যে আসায় উপনির্বাচনে তার প্রভাব কতটা পড়বে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে বিরোধী দলগুলির মধ্যে।
নুরুল হাড়োয়ার দু’বারের বিধায়ক ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ৮০ হাজার ৯৭৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন আইএসএফ প্রার্থী। তিনি পেয়েছিলেন ২১.৭৩ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ১৬.৯৩ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, বিরোধীদের থেকে তৃণমূল এখানে এগিয়ে অনেকটাই। রবিউল এর আগে হাড়োয়া থেকে জিতে জেলা পরিষদের সদস্য হন। পরে অবশ্য ব্যক্তিগত ব্যবসার কারণে পদত্যাগ করেছিলেন। চেনা মাঠে ভোটের লড়াই তাঁকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলে মত শাসক দলের অন্দরে। কিন্তু তারপরেও নিজেদের মধ্যে দলাদলির সুবিধা নেবে না তো বিরোধীরা, শুরু হয়েছে এই গুঞ্জন।রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, হাড়োয়া বিধানসভা এলাকাটি সংখ্যালঘু প্রধান। তাঁদের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব এখনও প্রশ্নাতীত। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার খুন-ধর্ষণের ঘটনায় রাজ্যজুড়ে নাগরিক সমাজ পথে নামলেও হাড়োয়া বিধানসভা এলাকায় খুব বেশি কর্মসূচি দেখা যায়নি। যে ক’টি কর্মসূচি হয়েছে, তাতে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি কম ছিল বলেই স্থানীয় সূত্রের খবর। দুর্গাপুজোয় এখানে প্রচুর পুজো উদ্যোক্তা রাজ্য সরকারের অনুদানও নিয়েছিলেন।
তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মনে করছে, তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের ফলে বাড়তি সুবিধা তারা পাবে। সিপিএমের উত্তর ২৪ জেলা কমিটির সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে গণ আন্দোলনের আবহে এ বার ভোট হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তৃণমূলের দুর্নীতি, দুষ্কৃতীরাজ এবং থ্রেট কালচারের বিরোধিতা করে পথে নেমেছেন।’’ সিপিএম বা বামেরা এখানে অবশ্য প্রার্থী দেয়নি। আসনটি তারা আইএএফকে ছেড়ে দিয়েছে। আইএসএফের জেলা সভাপতি তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজনৈতিক রেষারেষির জন্য নয়, নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা, এলাকা দখল নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল চলছে। এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি। তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের প্রভাব পড়বে উপনির্বাচনে। মানুষ যদি ভোট দিতে পারেন, আমরা ভাল ফল করব।’’ বসিরহাটের বাসিন্দা, জেলা কংগ্রেস (গ্রামীণ) সভাপতি অমিত মজুমদারের কথায়, ‘‘ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলে সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ। এর প্রভাব ভোটে অবশ্যই পড়বে।’’ বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য তাপস মিত্রের মতে, ‘‘তোলাবাজি এবং ভেড়ির টাকা লুট নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের সুফল নিশ্চয়ই এ বার বিজেপি উপনির্বাচনে পাবে।’’
তবে দলের গোষ্ঠীকোন্দলের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। হাড়োয়ার তৃণমূল প্রার্থী রবিউল বলেন, ‘‘যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, তা আমার বিধানসভা এলাকার নয়। দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব বিষয়গুলি দেখছেন। ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy