কারও চিন্তা কী ভাবে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। কেউ চাইছেন এমন কাজ করতে যাতে তাঁর এলাকা যেন সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। কেউ আবার ইতিমধ্যেই নিজের এলাকার নিকাশি সমস্যার সমাধানে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যস্ত। কিন্তু কারা এঁরা। না কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা তার প্রতিনিধি নন এঁরা। এঁদের সকলেই বনগাঁর পুর নির্বাচনে বিভিন্ন ওয়ার্ডে জিতেছেন। ভোটের আগে এলাকার মানুষকে পুর পরিষেবা নিয়ে যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা কী ভাবে পূরণ করা যায়, বোর্ড গঠনের আগেই তাঁদের চিন্তা-ভাবনায় তা ঠাঁই নিয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ পুরসভা থেকে মোট দশ জন পুরভোটে জিতে এই প্রথম কাউন্সিলর হয়েছেন। সকলেই শাসকদলের। বাইশ আসনের পুরসভায় দশজনই নতুন মুখ। ভোটের প্রচারে বেরিয়ে যাঁরা জেনে গিয়েছেন তাঁদের ওয়ার্ডের সমস্যা কি। আর সে কথা মনে রেখেই এঁরা সকলেই মোটামুটি নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা তৈরি করেছেন ওয়ার্ডের সার্বিক উন্নয়নের জন্য।
বোর্ড গঠন, শপথের মতো প্রশাসনিক কিছু কাজ বাকি। তবে সকলেই চাইছেন দ্রুত কাজ শুরু করতে। নতুন মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষজনের প্রত্যাশাও অনেক। তাঁদের কথায়, ‘‘প্রথমবারের কাউন্সিলরদের কাজ করার সদিচ্ছা ও উদ্যম আছে। তাঁরা কাজের মাধ্যমে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে চাইছেন। যা আখেরে ওয়ার্ডের মানুষেরই কাজে আসবে।’’
৬ নম্বর ওয়ার্ডটি দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএমের দখলে ছিল। ওই ওয়ার্ডে শাসক তৃণমূলের দলীয় কোন্দল কান পাতলেই শোনা যায়। অতীতে যার জেরে দলের প্রার্থীর হেরে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এ বার তাই ওয়ার্ডের বাইরে থেকে প্রার্থী করা হয়েছিল স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ মজুমদারকে। অতীতে ছাত্র পরিষদ, যুব কংগ্রেস করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসার কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে বেশি সময় দিতে পারতেন না বছর একান্নর দিলীপবাবু। বহিরাগত তকমা ছেড়ে ফেলে তিনি এ বার হারিয়েছেন ওই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের সিপিএম কাউন্সিলর তাপস মুখোপাধ্যায়কে। পুরসভার ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে পড়া ওয়ার্ডগুলির অন্যতম এই ওয়ার্ড। ফলে জয়ী হয়ে দায়িত্বও যে অনেক বেড়ে গিয়েছে তা বিলক্ষণ জানেন দিলীপবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে ওয়ার্ডের মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। হাজারো সমস্যা রয়েছে ওয়ার্ডে। তবে প্রথমেই নজর দেব নিকাশির হাল ফেরাতে। প্রতিটি গলিতে নিকাশি নালা তৈরির পাশাপাশি করব জীর্ণ রাস্তাগুলি সংস্কার করা হবে। ওয়ার্ডের বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। যাঁদের অনেকের মাথায় ছাদ বলতে এক টুকরো ত্রিপল। রাজ্য সরকার ও পুর প্রধানের সহযোগিতায় তাঁদের জন্য পাকা ঘরের চেষ্টা করব। দেখব কোনও মানুষ যাতে অনাহারে না থাকেন।’’
১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ বার কাউন্সিলর হয়েছেন দীপ্তেন্দু বিকাশ বৈরাগী। স্কুলশিক্ষক দীপ্তেন্দুবাবু গতবারও ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু হেরে যান। তাঁর বাড়ি নয় নম্বর ওয়ার্ডে। এ বার পুরসভার বিদায়ী উপ পুরপ্রধান কৃষ্ণা রায়ের সঙ্গে তাঁর ওয়ার্ড বিনিময় হয়। কৃষ্ণাদেবী নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে ৯ নম্বরে দাঁড়িয়েছিলেন। দীপ্তেন্দু দাঁড়ান ১০ নম্বরে। হারিয়েছেন বাম সমর্থিত নির্দল চঞ্চল বিশ্বাসকে। ওয়ার্ডের মানুষের মূল সমস্যা পানীয় জল। দীপ্তেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘মূল সড়ক ছাড়া ট্যাপের লাইন বা পানীয় জলের কল নেই। আমার প্রথম কাজ হবে ওয়ার্ডের সর্বত্র ট্যাপকলের লাইন পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছানোকে অগ্রাধিকার দেব।’’
সিপিএমের দখলে থাকা ১৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ বার কাউন্সিলর হয়েছেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মী মৌসুমী চক্রবর্তী। হারিয়েছেন সিপিএমের মায়া ঘোষকে। নিন্দুকেরা বলছেন, ছাপ্পা না হলে মৌসুমীদেবী জিততে পারতেন না। যদিও দলের লোকজনের বক্তব্য, মৌসুমী না দাঁড়ালে এই ওয়ার্ডে হয়তো হারতে হতো। ভোটে জিতে দায়িত্ব যে অনেক বেড়ে গেল তা বলছেন বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের অস্থায়ী কর্মী মৌসুমী। তাঁর কথায়, ‘‘আমার প্রথম কাজ হবে গরিব দুঃস্থ পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ আমাকেও অভাবের মধ্যে লেখাপড়া করতে হয়েছে। তাই জানি সেটা কতটা কষ্টের।’’ পাশাপাশি ওয়ার্ডের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছেন তিনি।
২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়ে শাসক দলের গীতা দাস হারিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী পম্পা সাহাকে। নিজের অটো আছে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত গীতাদেবীর কথায়, ‘‘নিকাশি এখানে মারাত্মক সমস্যা। সুষ্ঠ নিকাশির ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়ার্ডে যত্রতত্র ময়লা যাতে না পড়ে থাকে সে দিকে নজর দেব। গরিব মানুষ ষাঁদের ঘর নেই, তাঁদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে।’’ ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নিদর্ল প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন বনগাঁ শহর তৃণমূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনতোষ ওরফে লাল্টু নাথ। তাঁর কাছে হেরেছেন দলেরই অফিসিয়াল প্রার্থী সুফল হালদার। দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই দল তাঁকে বহিষ্কার করেছে। তবে তা নিয়ে ভাবিত নন তিনি। জানালেন, ‘‘কাজের সুযোগ যখন পেয়েছি, মানুষের কোনও অভিযোগ থাকতে দেব না। নদীকে ঘিরে এখানকার মানুষ বাঁচে। তাই ইছামতী নদীর স্নানের ঘাটগুলো আগে সংস্কার করব। নতুন রাস্তা ও ছোটদের জন্য একটি পার্ক তৈরি করব।’’
পিছিয়ে পড়ার তালিকায় থাকা ৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমকে হারিয়ে এ বার নির্বাচিত তৃণমূলের কার্তিক মণ্ডল। পেশায় চাষি কার্তিকবাবুর ভাবনায় অগ্রাধিকার পেয়েছে নিকাশির উন্নতি। বললেন, ‘‘বৃষ্টি হলে এমন এলাকা রয়েছে, জলই বের হতে চায় না। তাই আগে ওটার একটা হিল্লে করতে হবে। পানীয় জলের জন্য কাজ করতে হবে। আর রয়েছে রাস্তার কাজ।’’ চার নম্বর ওয়ার্ডের সোমাঞ্জনা মুখোপাধ্যায়, ১৯ নম্বরের শুভেন্দু মিস্ত্রি, ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দীপ্তি সরকার, ৩ নম্বর থেকে দীপালি বিশ্বাস, পুরসভায় এঁরা সকলেই এ বার প্রথম পা রাখবেন।
চোখে এলাকার উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামা এই সব নতুন কাউন্সিলাররা তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল হন সেদিকেই তাকিয়ে থাকবেন ওই সব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy