ধৃত: রঞ্জিতকুমার বিশ্বাস, রিনারানি রায়, সমীরকুমার রায় (বাঁ দিক থেকে)
জাল ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরির চক্র ইদানীং আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে পুলিশের দাবি। ফলে, বাড়ছে বেআইনি কার্যকলাপও। পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে প্রতি মাসে ভারতীয় পাসপোর্ট-সহ গড়ে প্রায় ৮জন বাংলাদেশি ধরা পড়ছে পেট্রাপোলে। গত দু’বছর লকডাউনে অনুপ্রবেশের ঘটনা প্রায় বন্ধ ছিল। তার আগে এই সংখ্যাটা সীমবদ্ধ ছিল ৪-৫ এর মধ্যে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, চোরাপথে আসা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের একটি বড় অংশই আর দেশে ফিরে যায় না। এখানেই দালাল ধরে টাকার বিনিময়ে ভারতীয় ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড, জন্ম শংসাপত্র বানিয়ে নেয়। সে সব নথিপত্র দেখিয়ে তারা ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে ফেলে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ কাজের জন্য গোটা দেশ জুড়েই বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে।
বুধবার সকালে ভারতীয় পাসপোর্ট-সহ ৩ বাংলাদেশিকে আটক করল অভিবাসন দফতরের কর্তারা। ঘটনাটি ঘটেছে ভারত-বাংলাদেশ পেট্রাপোল সীমান্তে। ধৃতদের পরে অভিবাসন দফতরের তরফে পেট্রাপোল থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম রিনারানি রায়, রঞ্জিতকুমার বিশ্বাস এবং সমীরকুমার রায়। সকলেরই বয়স ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে। তাদের বৃহস্পতিবার বনগাঁ মহকুমা আদালতে তোলা হলে বিচারক জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পুলিশ ও অভিবাসন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রিনারানি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। বাড়ি খুলনায়। ২০১৭ সালে রিনা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এদেশে আসে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থানা এলাকায় থাকতে শুরু করে। সেখানে দালাল ধরে টাকার বিনিময়ে ভারতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। তৈরি করায় ভারতীয় পাসপোর্ট। রঞ্জিতের বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। সে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ২০১৫ সালে এদেশে আসে। বনগাঁর কালুপুর এলাকায় বসবাস শুরু করে। পরে রঞ্জিতও ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে দালাল ধরে। সমীর ২০১৫ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এ দেশে এসেছিল। থাকতে শুরু করে ক্যানিং থানা এলাকায়। তার কাছেও ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে। পুলিশ জানায়, ধৃতদের জেরা করে বেআইনি নথি তৈরির চক্রের খোঁজ চলছে।
কী ভাবে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করছে বাংলাদেশিরা?
পুলিশ জানায়, সীমান্তের নজরদারি এড়িয়ে অনেক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বেআইনি ভাবে ভারতে ঢোকে। এরা আত্মীয় বা অন্য কোনও পরিচিতের বাড়িতে থাকতে শুরু করে। অনেকে বাড়ি ভাড়া নেয়। ধীরে ধীরে দালাল ধরে জাল নথি তৈরি শুরু হয়। ভারতীয় কাউকে টাকার বিনিময়ে বাবা-মা সাজিয়ে পরিচয়পত্র তৈরি করে তারা। পরবর্তী সময়ে সেই সব নথিপত্র দেখিয়ে তৈরি হয়ে যায় ‘আসল’ ভারতীয় পাসপোর্ট। অনেক বাংলাদেশি আবার বৈধ পাসপোর্ট নিয়েই এ দেশে ঢোকে। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও এখানেই থেকে যায়। পরে একই পদ্ধতিতে দালাল ধরে তৈরি করে নকল পরিচয়পত্র।
অনেকে আবার ভারতে এসে ধীরে ধীরে নিজের পরিচিতি বাড়িয়ে তোলে। দান-খয়রাতি, ভোজের আয়োজন, স্থানীয় ক্লাবে মোটা অঙ্কের চাঁদা ইত্যাদির মাধ্যমে এলাকায় সুনাম কেনার চেষ্টা করে। জাল নথি তৈরির পর জমি কিনে বাড়িঘরও তৈরি করে নেয়। সম্প্রতি ইডি বাংলাদেশের একটি আর্থিক দুর্নীতির মামলায় অশোকনগর থেকে ২ জনকে গ্রেফতার করেছিল। তদন্তে জানা যায়, তারা বাংলাদেশ থেকে এসে এ দেশের জাল পরিচয়পত্র তৈরি করেছিল। জমি কিনে বাড়ি করেছিল। এমনকি ভোট দিয়েছিল বলেও অভিযোগ।
পুলিশ জানাচ্ছে, চোরাপথে একবার ঢুকে পড়লে অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। যদিও সীমান্ত এলাকার মানুষদের বার বার নতুন কাউকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া বা জমি বিক্রির আগে সতর্ক থাকতে প্রচার চালানো হয়। পরিচয়পত্র দেখতে বলা হয়। তবুও বেশি টাকার লোভে অনেকেই সে সব পদক্ষেপ এড়িয়ে যান। দালাল চক্রের মাধ্যমে জাল পরিচয়পত্র তৈরি হয়ে গেলে তাদের ধরা আরও মুশকিল হয়ে পড়ে। বছর কয়েক আগে দালাল চক্রের এক পাণ্ডাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল পেট্রাপোল থেকে। তাকে জেরা করে জানা গিয়েছিল, দিল্লি, চেন্নাই, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চক্রটির জাল বিস্তৃত রয়েছে। মোটামুটি ভারতীয় মুদ্রায় ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা দিলে মেলে ভারতীয় পাসপোর্ট।
কেন ভারতীয় পাসপোর্টে এত চাহিদা?
একটি সূত্র জানাচ্ছে, আরব দেশগুলিতে বাংলাদেশিদের শ্রমিকের কাজে নেওয়া হয় না। কিন্তুসেখানে ভারতীয় শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। তাই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে কাজে যুক্ত হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আরবে যেতে খরচও বেশি পড়ে। কিন্তু ভারতে সেই খরচ তুলনায় অনেকটা কম। আবার অনেকে বিভিন্ন অনুদান, ভাতা, প্রকল্প ইত্যাদি সুবিধার লোভে এ দেশেই থেকে যেতে আগ্রহী হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy