মারধর: ভূত তাড়াতে। ফাইল চিত্র
বাড়ির উঠোনে মাটিতে বসে সদ্য বিবাহিত তরুণীকে। সামনে জলের কলসি। হাতে ঝাঁটা নিয়ে তরুণীকে পেটাচ্ছেন এক ওঝা। আর্তনাদ করে উঠছেন তরুণী। মাঝে মধ্যে ওঝা তাঁর পিঠে লাথি মারছে। কাঁদতে কাঁদতে হাঁফাচ্ছেন মহিলা।
অত্যাচারের এই দৃশ্য চলছে ‘ভূত তাড়ানোর’ নামে। উঠোনে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে যা উপভোগ করছেন গ্রামের মানুষ।
কয়েক মাস আগে ঘটনাটি ঘটেছিল গাইঘাটার মধ্য বকচরা এলাকায়। মাঝে মধ্যেই গ্রামে তরুণীদের উপরে ভূত ছাড়ানোর জন্য চলে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। এখনও কুসংস্কারের বেড়া জালে আটকে রয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ, বাগদা, গোপালনগর, গাইঘাটা, হাবড়া, দেগঙ্গার বহু মানুষ।
মধ্য বকচরায় তরুণীর উপরে নির্যাতনের ঘটনার পরে গ্রামকে কুসংস্কারমুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চ। মঞ্চের তরফে গ্রামে এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হচ্ছে। অধ্যাপক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী-সহ বিশিষ্ট মানুষেরা গ্রামবাসীদের ভূত, ঝাঁকফুক, তুকতাক, জলপোড়া, তেলপোড়া নিয়ে সচেতন করেন। মঞ্চের সদস্যেরা বাসিন্দাদের হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখান, জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীকে ওঝা যে চুন জল দিয়ে হাত ধুইয়ে হলুদ বের করেন, তার পিছনে রয়েছে নেহাতই চালাকি। হাতে আমের কষ মেখে চুন জলে হাত রাখলে হলুদ রঙ জল থেকে বের হয়।
মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলেন, ‘‘আমাদের প্রচারের পরে ওই গ্রামের মানুষ এখন অনেকটাই সচেতন হয়েছেন।’’ তবে বার্তাটা সকলের মধ্যে ছড়িয়েছে এমন নয়। তবে প্রদীপের কথায়, ‘‘আমরা অন্তত গ্রামবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার নিয়ে বিতর্কটা বাধিয়ে দিতে পেরেছি।’’
সাপে কাটা থেকে শুরু করে জ্বরজারিতেও ওঝা-গুনিনের শ্মরণাপন্ন হন অনেকে। তার উপরে কিছু কিছু মানসিক রোগকে ‘ভূতে ধরা’ নাম দিয়েও ওঝার কেরামতি চলে। এ সব রোগ সরকারি হাসপাতাল বা অন্যত্র চিকিৎসকের পরামর্শে সারতে পারে, সেই বিশ্বাসই এখনও জন্মায়নি অনেকের মধ্যে। ওঝা-গুনিনের পাল্লায় পড়ে টাকার নয়ছয় তো হয়ই, প্রাণ যায় অনেকের— এই বার্তাই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে নানা স্তরে।
গাজল ব্লকে গুণিনের ঝাড়ফুঁকে অসুস্থ দুই শিশুর মৃত্যু হয়। গত বছর দেগঙ্গা ব্লকে জ্বরে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। হাবড়ার গণদীপায়ন এলাকায় মরা মানুষকে বাঁচাতে ওঝা ডাকা হয়েছিল। ওঝা ঝাড়ফুঁক করে ব্যর্থ হওয়ার পর মানুষ তাঁকে গণধোলাই দিয়েছিল। কয়েক বছর আগে গোপালনগরের রসুলপুরে জলে ডুবে এক শিশুর মৃত্যুর পরে ওঝা এসে তাকে দীর্ঘক্ষণ নুন চাপা দিয়ে রেখেছিল। বাগদার গ্রামে কয়েক বছর আগে এক কিশোরীর জ্বর সারাতে ওঝা সারা রাত ঝাঁটাপেটা করেছিল। কিশোরী পরে মারা যায়।
সম্প্রতি গাইঘাটার উত্তর বকচরা এলাকায় রাতে একটি বাড়িতে ইট পাটকেল পড়ছিল। কয়েকজন রটিয়ে দেয়, বাড়িতে ভূত রয়েছে। ওঝা ডাকতে বলে কেউ কেউ। যদিও গ্রামের কয়েকজন যুবক তাতে বাধা দেন। তাঁরাই রাতপাহারা দেন। ইট পাটকেল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রদীপ বলেন, ‘‘একটি চক্র বাড়ি থেকে লোকজনকে উচ্ছেদ করে দখল নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের প্রচারের পরে মানুষ সচেতন হওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। মানুষ এখন রোগ হলে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন।’’ মঞ্চের তরফে বনগাঁর চাঁদা এলাকায় একটি বুজরুকি কারবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশের পদক্ষেপও জরুরি বলে মনে করেন প্রদীপ।
তিনি জানান, ওঝা-গুণিন কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এবং অশিক্ষার কারণে মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন রয়েছেন। স্বাস্ব্য পরিষেবা সঠিক ভাবে না পেয়ে মানুষের একাংশ ওঝার উপরে বিশ্বাস করছেন। কিছু মানুষ ঝাড়ফুঁক-তুকতাকের উপরে বিশ্বাস করে বেঁচে রয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথাগত ভাবে এটা চলে আসছে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে বোঝাতে যথেষ্ট সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে। প্রদীপদের বিশ্বাস, সময় লাগবে। দীর্ঘদিনের বিশ্বাস হঠাৎ যাবে না।’’ নিয়মিত গ্রামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন করার কাজ করে গেলে সুফল মিলবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, খবর পেলেই তাঁরা বুজরুকির কারবার বন্ধ করেন। মানুষকে সচেতন করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy