হয়রান: টিকাকরণের লাইনে বৃদ্ধা। বৃহস্পতিবার আকাইপুরে। ছবিটি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক
কোথাও রোদে পুড়ছেন মানুষ, ঘেমেনেয়ে একসা হচ্ছেন। কোথাও রাত থাকতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন অশীতিপর বৃদ্ধ। সেই লাইনের পাশে না আছে জল, না আছে শৌচালয়ের ব্যবস্থা। কোথাও ইট পেতে লাইন রেখে দূরে গাছের ছায়া খুঁজে নিচ্ছেন ভ্যাকসিনের খোঁজে হন্যে হয়ে ফেরা মানুষ। তা-ও যদি একদিনে কাজ সারা যেত, তা হলেও হত। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে শুনতে হচ্ছে, স্টক শেষ, অন্য দিন আসুন। লাইনে অপেক্ষমান মানুষের জন্য সামান্যতম পরিষেবাটুকুর ব্যবস্থা নেই বেশিরভাগ জায়গায়। কী পদ্ধতিতে এই ভোগান্তি কমতে পারে, সেই দিশাও দেখাতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা। অসহনীয় এই পরিস্থিতিতে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের কপালকেই দুষছেন মানুষজন।
বৃহস্পতিবার বনগাঁ ব্লকের আকাইপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে জানা গেল, কোভিড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। বেলা ১টায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে চাঁদিফাটা রোদে বহু মানুষ অপেক্ষা করছেন। একফালি অংশে মাথার উপরে ত্রিপল টাঙানো। রোদ থেকে বাঁচতে সেখানেই গাদাগাদি করেছেন অনেকে। লাইনের পাশেই বসে পড়েছেন অনেকে। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।
নিত্যগোপাল বিশ্বাস নামে এক বৃদ্ধ সকাল ৬টার সময়ে সন্তোষপুর গ্রামের বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। দুপুর ১টা নাগাদ প্রতিষেধক নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বললেন, ‘‘তীব্র রোদের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা কি মানুষ না গরু-ছাগল?’’ বৃদ্ধের প্রশ্ন, ‘‘প্রতিষেধক নিতে এসে এই দুর্ভোগ কেন সহ্য করতে হবে আমাদের?’’ প্রশ্ন করলেন বটে, কিন্তু উত্তর দেবে কে, জানেন না।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে মাটিতে বসেছিলেন বৃদ্ধা চরণদাসী বাইন। স্বামী ক্ষিতীশ বাইনের সঙ্গে সকাল ৮টার সময়ে এসেছিলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। দুপুরে প্রতিষেধক নিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে বললেন, ‘‘এই রোদে দাঁড়িয়েই মনে হয় অসুস্থ হয়ে পড়ব। প্রশাসন কি আমাদের জন্য একটা পাখার ব্যবস্থাও করতে পারে না?’’
অমর সাহা এক যুবকের কথায়, ‘‘পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। স্বাস্ব্যকেন্দ্রের নলকূপগুলো অকেজো। একটি কল আছে, তা আর্সেনিকপ্রবণ। মানুষ বাধ্য হয়ে সেই জল পান করছেন। মহিলাদের জন্য শৌচালয় নেই। পুরুষদের শৌচালয় ব্যবহার করছেন তাঁরা। অমানুষিক অবস্থা।’’
বুধবার সিপিএমের পক্ষ থেকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অব্যবস্থা নিয়ে ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। দলের নেতা পীযূষকান্তি সাহা বলেন, ‘‘প্রতিষেধক নিতে আসা মানুষদের জন্য আমরা ছাউনি, পাখা, পানীয় জল, শৌচালয়ের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছি।’’ বনগাঁর বিএমওএইচ মৃগাঙ্ক সাহা বলেন, ‘‘প্রতিষেধক নিতে আসা মানুষদের জন্য পরিকাঠামো বাড়াতে জেলাশাসক ইতিমধ্যেই বিডিও এবং পঞ্চায়েতকে নির্দেশ দিয়েছেন। শীঘ্রই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’
কবে নড়ে বসবেন কর্তারা, তা অবশ্য জানেন না কেউ।
একই পরিস্থিতি সন্দেশখালিতে। সন্দেশখালি ২ নম্বর ব্লকের খুলনা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে। সেখানে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানুষ রোদের মধ্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের মাথার উপরে নেই ছাউনি, নেই। বসার ব্যবস্থা, পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। বয়স্কদের দীর্ঘক্ষণ ছাতা নিয়ে ভিড় মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক কৌশিক মণ্ডল বলেন, ‘‘বাইরে ছাউনি দেওয়ার বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’
কর্তারা যখন বিষয়টি ‘দেখছেন’, তখন লাইনে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছতে মুছতে মানুষ বলছেন, ‘‘ওঁরা তো ঠান্ডা ঘরে বসে, বুঝতে পারছেন না আমাদের কী জ্বালা!’’ উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসত ব্যারাকপুর মহকুমার অনেক জায়গায় প্রতিষেধক নিতে আসা মানুষদের জন্য সামান্য পরিকাঠামোও তৈরি করতে পারেনি প্রশাসন। ভ্যাকসিনের কাজটা আপাতত শেষ হওয়ার নয়। বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। পরে হয় তো সরকারের টনক নড়বে। কিন্তু শুরুর দিকে যাঁরা ভোগান্তির শিকার হলেন, তাঁরা কার কাছে এর জবাব চাইবেন, জানেন না।
একদিকে ভ্যাকসিন কেন্দ্রের অব্যবস্থা, অন্য দিকে জেলায় পর্যাপ্ত প্রতিষেধক মজুত না থাকায় সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। বুধবার থেকে জেলার বেশিরভাগ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন দেওয়া হচ্ছে দ্বিতীয় ডোজ। হিঙ্গলগঞ্জের বিএমওএইচ অঙ্কুর কর্মকার বলেন, ‘‘আপাতত দ্বিতীয় ডোজ নিতে যাঁরা আসছেন, তাঁদের ফেরানো হচ্ছে না।’’
টাকি গ্রামীণ হাসপাতালের মতো কিছু জায়গায় লাইনে ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিষেধক নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে কুপন ব্যবস্থা চালু করলে মানুষ কি স্বস্তি পেতে পারেন? কয়েকজন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের মতে, বিষয়টি সম্ভব নয়। তাঁদের যুক্তি, জেলায় প্রতিষেধক সরবরাহ অনিয়মিত। তাই কবে কতজন মানুষকে আমরা প্রতিষেধক দিতে পারব, নিজেরাই জানি না। কুপন দিয়ে প্রতিষেধক দিতে না পারলে সমস্যা আরও জটিল হবে। কুপুন চুরি হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
তা হলে কি কোনও উপায় নেই এই ভোগান্তির হাত থেকে বাঁচার?
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বনগাঁ শাখার সম্পাদক, চিকিৎসক আশিসকান্তি হীরা বলেন, ‘‘দু’টি কাউন্টার করতে হবে। একটি কাউন্টার থেকে প্রতিষেধক দেওয়া হবে। অন্য কাউন্টার থেকে মানুষের নাম এন্ট্রি করে তাঁকে নম্বর দিয়ে দেওয়া হোক। পরে যে দিন তাঁদের প্রতিষেধক দেওয়া হবে, তাঁদের ফোন করে বা মেসেজ করে জানিয়ে দেওয়া হোক। এই কাজে স্বাস্থ্যকর্মী বা পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা হোক। এখন যে ভাবে প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। করোনা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।’’ জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা বলেন, ‘‘ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলিতে ছাউনি, পাখা, পানীয় জলের ব্যবস্থা করার কাজ শুরু হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy