Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

জলে ডুবেছে খেত, মাথায় হাত চাষির

মাঘ-ফাল্গুন মাসে চার বিঘে জমিতে ওল চাষ করেছিলেন বনগাঁর পোলতা মৌজার চাষি পরিতোষ মল্লিক। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ওই ওল ওঠার কথা। কিন্তু সম্প্রতি ভারি বৃষ্টিতে পরিতোষবাবুর ওল খেত এখন সম্পূর্ণ জলের তলায়। পরিতোষবাবু জানালেন, এখানকার ওল উত্তরপ্রদেশে যায়।

ডোবা জলে নষ্ট হয়েছে বিঘের পর বিঘে ওল চাষ।

ডোবা জলে নষ্ট হয়েছে বিঘের পর বিঘে ওল চাষ।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৫ ০২:০২
Share: Save:

মাঘ-ফাল্গুন মাসে চার বিঘে জমিতে ওল চাষ করেছিলেন বনগাঁর পোলতা মৌজার চাষি পরিতোষ মল্লিক। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ওই ওল ওঠার কথা। কিন্তু সম্প্রতি ভারি বৃষ্টিতে পরিতোষবাবুর ওল খেত এখন সম্পূর্ণ জলের তলায়। পরিতোষবাবু জানালেন, এখানকার ওল উত্তরপ্রদেশে যায়। লাভজনক চাষ। চার বিঘে জমিতে ওল চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। নিজের পুঁজি থেকে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ করে চাষ করেছিলেন। এখন কী ভাবে সেই ধার শোধ করবেন, তা ভেবে রাতের ঘুম উড়েছে পরিতোষবাবুর। বললেন, ‘‘এখন অন্য কাজ খুঁজতে হবে। তা না হলে খাব কী!’’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কৃষি দফতরের উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) অরূপ দাস জানিয়েছেন, বনগাঁ মহকুমা-সহ গোটা জেলায় প্রায় একশো কোটিরও বেশি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের মধ্যে বিনামূল্যে ধানের বীজ বিতরণ করার কাজ শুরু হয়েছে।

তবে আপাতত সমস্যা কমার লক্ষণ নেই চাষি বা কৃষিশ্রমিকদের, শুধু পরিতোষবাবুই নন, গোটা বনগাঁ মহকুমার বহু চাষিই ক’দিনের বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত। মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেল বিস্তীর্ণ এলাকায় সব্জি খেত, পাট খেত, বীজতলা এখনও জলের তলায়। বনগাঁ মহকুমা সব্জিচাষে বিখ্যাত। স্থানীয় মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে ওই সব্জি ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়। মহকুমার বেশিরভাগ মানুষের অন্যতম জীবিকা সব্জিচাষ। বেগুন, পটল, পেঁপে, ওল, কলা-সহ নানা সব্জির ক্ষতি হয়েছে।

স্থানীয় নতুনগ্রামের চাষি শঙ্করহরি বিশ্বাসের দশ কাঠা পটল এবং সাত কাঠা জমির বেগুন জলের তলায়। শঙ্করহরিবাবু জানালেন, খেতের জমা জল সরছে না। স্থানীয় পোলতা বাওরের সঙ্গে ইছামতী নদীর সংযোগ আছে। কিন্তু নদী জল টানছে না। এই পরিস্থিতিতে যতক্ষণ টানা ক’দিন কড়া রোদ হচ্ছে, তত দিন জল শুকোবে না।


জমা জলের নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সময়ের আগে পাটও কেটে নিচ্ছেন চাষিরা।

বনগাঁ মহকুমার চাষিরা জানালেন, শ্রাবণ মাসে অত বৃষ্টি বহু দিন তাঁরা দেখেননি। মূলত এখানে দুর্গাপুজোর আগে বৃষ্টি হয়। তখন সব্জি চাষে ততটা ক্ষতি হয় না। কিন্তু এ বার আগেই ভারি বৃষ্টিতে খেতে জল জমে গিয়েছে। ওই জল সরতে সরতে মাস চারেক সময় লেগে যাবে বলে মনে করছেন চাষিরা। ফলে দুর্গাপুজোর আনন্দ কার্যত ম্লান হতে চলেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

দু’বিঘে জমিতে পাট করেছিলেন স্থানীয় শিবপুরের বাসিন্দা সুনীল হালদার। তাঁর জমিতে ইছামতীর নদীর জল ঢুকে পড়েছে। মাথা সমান জল দাঁড়িয়ে খেতে। নদীর সঙ্গে চাষের জমি আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সোমবার সকালে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, জলে ডোবা ওই পাট শ্রমিক লাগিয়ে কেটে নিচ্ছেন তিনি। সুনীলবাবুর কথায়, ‘‘পাট এখনও কাটার সময় হয়নি। ভাদ্র মাসে পাট কাটার প্রকৃত সময়। কিন্তু পাট খেত জলে ডুবে যাওয়ায় ফসল কেটে নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ, এখন পাট না কাটলে গোড়া পচে নষ্ট হয়ে যাবে।’’ কিন্তু সময়ের আগে কেটে নেওয়া পাটে আঁশ এখনও ভাল হয়নি বলে জানালেন। কিন্তু উপায়ই বা কী! ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে। সুনীলবাবু জানালেন, জলের মধ্যে শ্রমিক লাগিয়ে দু’বিঘে জমি থেকে পাট কাটতে এবং বাঁধতে খরচ পড়ছে চার হাজার টাকা। স্বাভাবিক সময়ে খরচ হয় দেড় হাজার টাকা। সব খরচ ধরে এই পাট বিক্রি করে যে দাম মিলবে, তাতে চাষের খরচ উঠবে না বলে জানালেন ওই চাষি।

শিবপুরের গ্রামের জগ বৈদ্য অন্যের জমি বিঘে প্রতি ছ’হাজার টাকা ভাগে নিয়ে চার বিঘে জমিতে সব্জি চাষ করেছিলেন। গোটা খেত জলের তলায়। জগবাবু বলেন, ‘‘ইছামতীর জল উল্টে খেতে ঢুকে পড়েছে। নদী আর খেত সমান হয়ে গিয়েছে। বাঁচার আর কোনও রাস্তা নেই।’’ বাগদার রমেন ঢালি বা গাইঘাটার বিষ্ণু বিশ্বাসের সব্জি খেতও জলের তলায়।

এরই মধ্যে যাঁদের কিছুটা সব্জি বেঁচে আছে, তাঁরা চড়া দর পাচ্ছেন। বনগাঁর চাষিরা জানালেন, সোমবারই স্থানীয় মতিগঞ্জনের হাটে পটল বিক্রি করেছেন কিলো প্রতি ২৫ টাকা। দরে। কিছু দিন আগেও যা ছিল কিলো প্রতি ৫ টাকা। তবে ওই সব চাষির সংখ্যা নেহাতই কম। বৃষ্টির ধাক্কায় বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন বাজার এবং হাটের খোলা বাজারে সব্জির মূল্য হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষও বাজারে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। মহকুমার বহু মানুষ বছর ভর খেত মজুরি করে সংসার চালান। তাঁরাও এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ভিন রাজ্যে ঠিকা শ্রমিকের কাজে চলে যাচ্ছেন।

বনগাঁ ব্লক কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধুমাত্র বনগাঁ ব্লকেই ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ২০০শো ৮৮ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে সব্জি রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৭৮৭ হেক্টর এলাকার। ক্ষতিগ্রস্ত চাষির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।

বনগাঁ ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তা শঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ‘‘ধানের বীজতলা তৈরির সময় রয়েছে ১৫ অগস্ট পর্যন্ত। আমরা চাষিদের মধ্যে ধানের বীজ বিতরণ করছি। পঞ্চায়েতগুলির কাছে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। একবারে নিচু জমিতে আর চাষের সম্ভাবনা নেই। তবে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি, যেখানে জল জমে ছিল কিন্তু এখন নামতে শুরু করছে সেখানে ধান করা সম্ভব।’’

যদিও চাষিরা এমন সম্ভাবনা দেখছেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণই নেই। আর জমা জল বের হওয়ার পথ নেই।’’

নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE