পরাজিত হলেও নায়কের সম্মান পেলেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রশান্ত সরখেল।
১৪টি আসনের জয়নগর পুরসভায় গত বার মাত্র ২টি আসনে জয়ী হয়ে এসইউসি ও নির্দলকে নিয়ে বোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। সে বারও কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ বারও ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে রইল পুরবোর্ডের ভাগ্য। তৃণমূল এখানে পেয়েছে ৪টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে ৬টি। এসইউসি জয়ী হয়েছে ২টি আসনে। নির্দল এবং সিপিএম পেয়েছে একটি করে আসন। পুরবোর্ড গড়ার দৌড়ে তারাই এগিয়ে, এমন দাবি করতে শুরু করেছে। তবে সে ক্ষেত্রে যে অন্য কোনও দল বা নির্দলের সমর্থন লাগবে, তা-ও স্পষ্ট। কয়েকটি ওয়ার্ডে এখানে আগেই স্থানীয় স্তরে আসন সমঝোতা করে লড়েছে কংগ্রেস-এসইউসি-বিজেপি-বামেরা। ফলে ওই আসনগুলিতে তৃণমূলের সঙ্গে একক লড়াই হয়েছে বিরোধীদের। তৃণমূল নেতা গৌর সরকার বলেন, ‘‘সব বিরোধী দল মিলে অশুভ শক্তির আঁতাত করে আমাদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। এটা সঠিক জয় নয়। অশুভ শক্তির জোটের জয়।’’ মূলত তৃণমূল বোর্ডের বিরুদ্ধে অনুন্নয়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই ভোটে গিয়েছিল বিরোধীরা। দীর্ঘ বছর এখানে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অর্ণব রায় বলেন, ‘‘এখানে মানুষ এখনও কংগ্রেসকে ভালবাসেন। দুর্নীতিগ্রস্ত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাঁরা।’’
এ বার পুরসভার ১৪টি আসনের সব ক’টিতে তৃণমূল প্রার্থী দিলেও কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল ১২টি আসনে। বাকি দু’টি আসন ৯ ও ১২ নম্বরে নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করে তারা। একই ভাবে শাসক দলের আর এক প্রতিপক্ষ এসইউসি ১১টি আসনে প্রার্থী দিলেও নাগরিক মঞ্চের সমর্থনে বাকি ৫, ১০, ১২ নম্বর ওয়ার্ডগুলিতে নির্দল প্রাথীকেই সমর্থন করেছে।
নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে ১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিদায়ী পুরপ্রধান ফরিদা বেগম শেখের মূল প্রতিপক্ষ ছিলেন কংগ্রেসের ৬ বারের পুরপ্রধান প্রশান্ত সরখেল। প্রশান্তবাবুর প্রাপ্ত ভোট ৭৮৯টি। ফরিদা বেগম শেখ পেয়েছেন ৮৮২টি ভোট। ৯৩ ভোটে জিতেছেন বিদায়ী পুরপ্রধান। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ভাল ফল না করার কারণ, বিরোধী শক্তি এখানে জোট করে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। বিরোধীরা দেখেছে, আমরা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে যে ভাবে উন্নয়ন করেছি, তাতে ওরা বুঝতে পেরেছে আমরা ফের ক্ষমতায় এলে উন্নয়নের কাজ করব। যা দেখে জনগণের কাছে ওদের অস্তিত্বই থাকবে না।’’
প্রশান্তবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমি হারলেও আমার দল জিতেছে। এতেই আমি খুশি। তা ছাড়া, ওই প্রার্থীর মতো লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি ভোট কিনতে যাইনি। মানুষ আমাকে ভালবেসে ভোট দিয়েছেন।’’ কংগ্রেসই যে এ বার পুরবোর্ড গড়বে, সেই দাবি এখনই জানিয়ে রেখেছেন প্রশান্তবাবু। জয়নগর পুরসভায় কংগ্রেসের মূল কাণ্ডারী যে গোপালদাই (প্রশান্তবাবু এ নামেই পরিচিত এলাকায়), সে কথা সকলেই এক বাক্যে মানেন। কংগ্রেস যদি বোর্ড গড়ে, পুরপ্রধানের আসনে যে-ই বসুন না কেন, প্রশান্তবাবুর হাতে পুরসভার রাশ অনেকটাই থাকবে, তা-ও বিলক্ষণ জানেন এখানকার রাজনীতি সচেতন মানুষ।
২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের মৌসুমী ভট্টাচার্য পেয়েছেন ৩৮৫টি ভোট। তাঁর মূল প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের রীতা ব্রহ্মচারী ৯৩৩ পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের তুষারকান্তি রায় ওরফে বিটোর প্রাপ্ত ভোট ৮৮২। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলের দিব্যেন্দু রায় ওরফে গণেশ পেয়েছেন ৪১২টি ভোট। একই ভাবে ৪ নম্বর ওয়ার্ডটি গত দু’বার তৃণমূলের দখলে থাকলেও এ বার তা ছিনিয়ে নিয়েছে সিপিএম। ওই ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর ইন্দিরা দাসের স্বামী প্রভাস দাসের প্রাপ্ত ভোট ৫০৬টি। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএম প্রার্থী শুভাশিস দর ওরফে লাল্টু ৫৬২টি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী ছিলেন জয়নগর টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি প্রবীর চক্রবর্তীর স্ত্রী সুজাতা। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৫৯৮টি। এবং প্রতিপক্ষ এসইউসির প্রার্থী বাসবী চক্রবর্তী ৬৪৭টি ভোট পেয়ে জিতেছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওই দু’দলের লড়াই হয়। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী ইলিয়াস পৈলানের প্রাপ্ত ভোট ৭৫৮টি। সেখানে প্রধান প্রতিপক্ষ এসইউসি-র প্রাক্তন কাউন্সিলর সুদর্শন হালদার পেয়েছেন ৭৪৬টি ভোট। মাত্র ১২ ভোটে পরাজিত হয়েছেন বিদায়ী কাউন্সিলর। একই ভাবে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এসইউসি-র সন্ধ্যা চক্রবর্তীর প্রাপ্ত ভোট ৫০৬টি। প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস প্রার্থী জবারানি নন্দী (হালদার) পেয়েছেন ৪৭৪টি ভোট। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিদায়ী উপ পুরপ্রধান এসইউসি-র প্রার্থী প্রবীর বৈদ্যের প্রাপ্ত ভোট ৪১২টি। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের দেবাশিস পাল ৫৫৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নাগরিক জোটের নির্দল প্রার্থী মঞ্জুরানি চন্দের প্রাপ্ত ভোট ৫৭২টি। প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলের লাবণ্যপ্রভা হালদার ৭৩৯টি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী ফরিদা বেগম শেখ।
একই ভাবে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের কল্পনা দাস মণ্ডল পেয়েছেন ৪২০টি ভোট। প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের মিঠু দাসপুরকাইত ৫০৩টি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের অভিজিৎ সরকার পেয়েছেন ২৮০টি ভোট। কংগ্রেসের সুজিত সরখেল ৭৯৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন এই ওয়ার্ডে। একই ভাবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস ও এসইউসি সমর্থিত নির্দল প্রার্থী আজারউদ্দিন খানের প্রাপ্ত ভোট ৪১৬টি। সেখানে তৃণমূলের রথীন মণ্ডল ৭৫৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিমা দাস হালদারের প্রাপ্ত ভোট ৪২১টি। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের বুলবুল ঘোষদত্ত ৬২৬টি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিশ্বনাথ হালদারের প্রাপ্ত ভোট ২৯৭টি সেখানে এসইউসি প্রার্থী পঞ্চুগোপাল হালদার ৪১৯টি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
এসইউসি-র বিধায়ক তরুণ নস্কর বলেন, ‘‘ভোটের আগে তৃণমূল নানা ভাবে সন্ত্রাস চালিয়েছে। তবে ভোটের সময়ে সে ভাবে কিছু করতে পারেনি। সে কারণেই এমন ফল। আগের বোর্ডের অনুন্নয়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মানুষ।’’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy