Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

শিক্ষা আর লোক-উৎসবই গর্ব হাবরাবাসীর

‘হাবরা’ শহরের নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজ্যের মধ্যে অন্যতম সেরা শিক্ষা পরিকাঠামো ও ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসবের নাম। পাশাপাশি এখানকার মিষ্টি, বিশেষ করে দই-কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি তো গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ও পার বাংলা থেকে মানুষ এসে হাবরায় বসতি গড়ে তোলেন। এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলেমিশে তাঁরাই গড়ে তোলেন হাবরা শহর। পরবর্তী সময়ে বহু উন্নয়নের সাক্ষী থাকলেও যানজটের যন্ত্রণা থেকে শহরবাসীর রেহাই মেলেনি।

গ্রামসেবা সঙ্ঘ।

গ্রামসেবা সঙ্ঘ।

সীমান্ত মৈত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:০০
Share: Save:

‘হাবরা’ শহরের নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজ্যের মধ্যে অন্যতম সেরা শিক্ষা পরিকাঠামো ও ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসবের নাম। পাশাপাশি এখানকার মিষ্টি, বিশেষ করে দই-কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি তো গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ও পার বাংলা থেকে মানুষ এসে হাবরায় বসতি গড়ে তোলেন। এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলেমিশে তাঁরাই গড়ে তোলেন হাবরা শহর। পরবর্তী সময়ে বহু উন্নয়নের সাক্ষী থাকলেও যানজটের যন্ত্রণা থেকে শহরবাসীর রেহাই মেলেনি।

দেশভাগের পরে যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরের মতো জায়গা থেকে অনেকে এ পার বাংলায় এসে মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজে নিয়েছিলেন হাবরায়। প্রবীন মানুষজন জানালেন, তখন হাবরায় ঘর ভাড়া ছিল মাসে কমবেশি ৫ টাকা। এক কাঠা জমির দাম মেরেকেটে গোটা পনেরো টাকা। যানবাহন ব্যবস্থা বলতে ছিল হাবরা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত কয়লা-ইঞ্জিনচালিত ট্রেন। কিছু রিকশা ছিল বটে। কিন্তু এখনকার মতো ভ্যানের দৌরাত্ম্য ছিল না। সন্ধ্যার পরে গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে যেত। চারিদিকে ছিল বন-জঙ্গলে ঢাকা। শিয়াল, হায়না, বুনো শুয়োর, বিষাক্ত সাপখোপের আড্ডা ছিল গোটা এলাকায়। অতীতের স্রোতস্বিনী পদ্মা নদী তখনও পুরোপুরি মজে যায়নি। এখন অবশ্য পদ্মা তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নদী ভরাট করে বাড়ি ঘর বানিয়েছে। শহরের অন্যতম নিকাশি ব্যবস্থা ছিল ওই নদী। নদী ভরাট হয়ে নিকাশির সমস্যাও হয়েছ বলাইবাহুল্য।

হাবরা পুরসভা তৈরি হয় ১৯৭৯ সালে। প্রথম মনোনীত চেয়ারম্যান হন শঙ্করকন্ঠ মুখোপাধ্যায়। নির্বাচন হয় ১৯৮৮ সালে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সিপিএমের প্রণব ভট্টাচার্য। ২০১১ সালের শেষ জনগণনায় হাবরা শহরের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ২৬৭ জন। এলাকায় প্রাথমিক স্কুল রয়েছে ৪৫টি। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ২২টি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাণীপুরে ব্রিটিশ সেনাছাউনি ও সামরিক যুদ্ধ বিমানের ঘাঁটি তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধের পরে সেনাদের ফেলে যাওয়া এক হাজার বিঘে জমিতে বৃহত্তর বাণীপুর গড়ে ওঠে। বাণীপুরের নাম অবশ্য তখন ছিল ‘বাইগাছি’। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অখ্যাত ওই গ্রামের নাম পরিবর্তন হয় পরবর্তিতে। সেনা ছাউনি পাল্টে গড়ে ওঠে শিক্ষাশিবির। রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীজির শিক্ষাদর্শের সার্থক রূপায়ণ হয় বাণীপুরে। ১৯৪৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়। ওই বছরেরই শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় স্নাতকোত্তর বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় তথা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বেসিক ট্রেনিং কলেজ। ওই প্রতিষ্ঠানের উপরে বাণীপুরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে। ওই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত হিমাংশুবিমল মজুমদার। গত বছর ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। বাণীপুরের শিক্ষাকেন্দ্রের অন্যতম প্রধান স্থপতিও ছিলেন তিনি। বাণীপুর লোক উৎসবেরও তিনি ছিলেন প্রবর্তক। পরবর্তী সময়ে বাণীপুরের প্রাক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে (খেলাঘর) শুরু হয় বাণীপুর আর্ট সোসাইটি অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব কালচার। এখানে মাঝেমধ্যে চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন হয়। মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো হয়। রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপরে কর্মশালাও আয়োজিত হয়।

দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে তৈরি হয়েছে কলতান। ছবি: শান্তনু হালদার।

সম্পূর্ণ আবাসিক চরিত্রের এই শিক্ষক শিক্ষণ কেন্দ্রে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় আরও একটি করে নিম্ন বুনিয়াদি ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যাল। কলকাতা থেকে রাজ্যের প্রাচীনতম শারীর শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়কে বাণীপুরে নিয়ে আসা হয়ে ছিল ১৯৫৭ সালে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনতা মহাবিদ্যালয় তৈরি হয় গ্রাম সেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য। এখানে রয়েছে অনাথ পড়ুয়াদের জন্য রাষ্ট্রীয় কল্যাণভবন। গাঁধীজির শিক্ষার মূল আদর্শ অনুসারে এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সকলকেই কায়িক শ্রম ও উৎপাদনমূলক কাজে যোগ দিতে হত। এ ছাড়াও, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জহর নবোদয় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, অনাবাসী গর্ভমেন্ট কলেজ অব এডুকেশনের (বিএড) মতো বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। বাণীপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট প্রার্থনা সঙ্গীত (তিমির রাত্রি কারার প্রাচীর, টুটিল উষার আলোর আন্দোলনে, ধরণী বুকে জেগেছি আমরা অমানিশা অবসানে, ভেঙেছে দুর্গদ্বার, জড়তা মূর্খতার) ৬৩ বছর আগে হাটথুবা এলাকায় জঙ্গল কেটে বিপ্লবী শচীন্দ্রলাল করগুপ্ত শুরু করেছিলেন সেবাসঙ্ঘ তৈরির কাজ। বিরাট এলাকা নিয়ে তৈরি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মহিলাদের হাতে-কলমে নানা কুটিরশিল্পের শিক্ষাকেন্দ্র। পুরো এলাকা সাজানো হয় শান্তিনিকেতনের আদলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর দু’য়েকের মধ্যেই ও পার বাংলা থেকে শরণার্থীরা এসে ভিড় করেছিলেন হাবরায়। যে যেখানে পেরেছিলেন একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন সে সময়েই শরণার্থীদের সঙ্ঘবদ্ধ সামাজিক জীবনযাপনের জন্য হাবরা সেবাসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেন আন্দামান সেলুলার জেল-ফেরত বিপ্লবী শচীন্দ্রলাল করগুপ্ত। এটা হাবরাবাসীর কাছে ছিল শান্তিনিকেতনের মতোই।

হাবরার গর্বের আর একটি দিক হল বাণীপুর লোকউৎসব, যা শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। সরকারি উদ্যোগে এই উৎসব হলেও ১৯৮৬ সাল থেকে সাধারণ মানুষের উদ্যোগেই উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গোটা দেশ থেকে লোকশিল্পীরা এখানে আসেন। এলাকার মানুষের কাছে আজ এই উৎসব বার্ষিক পার্বণের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, উদয়শঙ্কর, অন্নদাশঙ্কর রায় কে আসেননি এই উৎসবে! এলাকার মানুষের কথায়, ‘‘বাণীপুরের জন্যই আমরা গোটা রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে জায়গা করতে পেরেছি। সারা রাজ্য থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করতে আসে। এটা একটা কাছে বড় পাওনা।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE