সমুদ্র সৈকতে চলছে মাইক-প্রচার।-নিজস্ব চিত্র।
কিছু দিন আগেই বকখালির সমুদ্রে এক শিক্ষক ও তিন ছাত্র তলিয়ে যাওয়ার পরের দিন কলকাতার মানিকতলা এলাকা থেকে আসা একদল যুবক সৈকতে ঘোরাঘুরি করছিল। সে সময় তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, বকখালির সমুদ্র দেখতে এসে চর দেখেই ফিরতে হবে নাকি! কারণ, সে দিন ভরা কোটালের ভাটা চলায় সমুদ্র সৈকত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছিল সমুদ্র। সৈকত থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর পড়ে যাওয়ায় প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছতে হবে সমুদ্রের কাছে। জলের টানে এগিয়ে যেতে গিয়েই মৃত্যু ডেকে আনেন অনেক পর্যটক। ফেরার পথে হঠাৎই জোয়ারের জলে বন্দি হয়ে পড়েন তাঁরা। গত এক বছরে বকখালি সমুদ্রে তলিয়ে প্রাণ গিয়েছে অনেকের। তাই এখন বকখালির চর পর্যটকদের কাছে মৃত্যুর হাতছানি।
কলকাতা বা কলকাতা লাগোয়া বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের কাছে বকখালিতে পিকনিক স্পটটি বহু দিন ধরেই বেশ জনপ্রিয়। হাতে দু’এক দিনের ছুটি থাকলেই অনেকে হই-হুল্লোড় করতে চলে আসেন বকখালিতে। মনোরম জল, মন মাতানো ঢেউ, চমৎকার সৈকত, পাশেই ঝাউবন ঘেরা জঙ্গল— সব মিলিয়ে বকখালির আকর্ষণ অনেক কিছুকে নিয়ে। এ ছাড়া কাছেই তৈরি হয়েছে হেনরিজ আইল্যান্ড। সেখানেও আসেন অনেকে। কিন্তু কখন জোয়ার এলে সমুদ্র কাছে আসবে, সেই ধৈর্য আর ক’জনের আছে। তাই অনেকেই ভাটার সমুদ্রেও চর ধরে বহু দূর এগিয়ে চলে যান জলের কাছে। বিপদ ডেকে আনেন এঁদের অনেকেই।
স্বাভাবিক অবস্থায় বকখালির সৈকত প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার লম্বা। চওড়ায় মেরেকেটে আধ কিলোমিটার। ভাটার সময়ে চর নিয়ে চওড়া হয়ে দাঁড়ায় প্রায় আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার। ভাটার সময়ে সমুদ্রে চর জেগে ওঠার পরে ওই আড়াই কিলোমিটার চরের উপর দিয়ে হেঁটে সমুদ্রের কাছে যেতে হলে সৈকত-লাগোয়া প্রায় ৫০ মিটার চওড়া কোমর সমান জল ঠেলে তারপর চরে ওঠা যায়। সেখান থেকে চলে যাওয়া যায় জলের পাড়ে। আড়াই কিলোমিটার হেঁটে ওই সমুদ্রে গিয়ে অনেকেই স্নানে নেমে পড়েন। ফেরার কথা আর মনে থাকে না। কখন জোয়ার শুরু হয়ে যায়, সে দিকে তখন আর কার নজর থাকবে! হঠাৎই ঘিরে ফেলে জোয়ারের জল। সাঁতার জানেন না অনেকেই। আর সমুদ্রের দাপটে সাঁতার জেনেও যে খুব লাভ হয়, তা নয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেল, চর পড়ে যাওয়ার পরে সমুদ্রের কাছে গিয়ে এবং জোয়ারের সময় ফেরার পথে গত বছর খানেকে জনা ১৫ মানুষ তলিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াচকের দুই ছাত্র শীর্ষাঙ্ক সরকার (১৯) ও চিরঞ্জয় সরকার (২১) ছিলেন। ভাটার সময় দূরের সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে যান তাঁরা। দু’দিন ধরে খোঁজাখুজির পরে চিরঞ্জয়ের দেহ উদ্ধার হলেও অন্য জন এখনও নিখোঁজ। ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউ দিল্লি থেকে আসা রাকেশকুমার যাদব (২১) নামে এক ছাত্র তলিয়ে যান। পর দিনেই সৈকতের অদূরে তাঁর দেহ মেলে। ২০১৩ সালের ১২ অগস্ট কলকাতার তিলজলা বেনিয়াপুকুর এলাকা থেকে আসা তিন পর্যটক আব্বাস হোসেন (২১), ইব্রাহিম আলম (২১) ও গোলাম মোস্তাফাও (২০) একই কারণে তলিয়ে যান। পরের দিন তিনটি দেহ উদ্ধার হয়েছিল। ওই বছর ১৫ অগস্ট নদিয়ার নবদ্বীপ এলাকা থেকে আসা অমিত মণ্ডল (২৯) তলিয়ে যাওয়ার পর দিনই দেহ উদ্ধার হয়েছিল। একই ভাবে গড়িয়ার শ্রীনগর থেকে আসা অর্কজ্যোতি ঘোষ (২১) তলিয়ে যান। দেহ উদ্ধার হয় তাঁর। ২০১৪ সালের ১৭ অগস্ট সোনারপুরের রাজপুর এলাকা থেকে আসা রঞ্জিত দাস তলিয়ে যান। দেহও উদ্ধার হয়। ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা এলাকার বাসিন্দা আজিজুর রহমান খান ও ১৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে আসা মোনালিসা গুপ্ত (২১) একই কারণে তলিয়ে যান। দু’জনেরই দেহ পরের দিন উদ্ধার হয়েছিল। শেষ সংযোজন এ বছর ২ জানুয়ারি। চর পড়ে যাওয়ায় দূরে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে যান কলকাতার একবালপুর এলাকা থেকে আসা প্রাইভেট শিক্ষক দীপক বাল্মীকি (৩০) ও তিন ছাত্র অভিষেক ধানুকা (১৮) চন্দন সাউ (২০) ও ফৈজল খান (১৮)। দু’দিন ধরে খোঁজাখুঁজির পরে তিন জনের দেহ উদ্ধার হলেও চন্দন সাউয়ের খোঁজ নেই। সব ক’টি দুর্ঘটনার দেখা গিয়েছে, কোন ছোট বাচ্চা বা মাঝবয়সী কেউ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অল্পবয়সীরাই বেপরোয়া হয়ে দূরের সমুদ্রে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন।
তবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও পুলিশকেও দায়ী করেন এলাকার বাসিন্দা ও পর্যটকেরা। তাঁদের বক্তব্য, ভাটার পরে সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরে ওই চর এলাকায় পুলিশের টহল থাকলে আর কেউ এগোতে সাহস পাবে না। সারা সৈকত জুড়ে সমুদ্রে নামা নিয়ে কোনও সতর্কীকরণ নোটিস নেই। চরের উপরে লাইন দিয়ে লাল পতাকা লাগিয়ে পর্যটকদের সর্তক করা যেতে পারে। মুরসুমের বিশেষ দিনগুলিতে পুলিশ স্পিড বোড নিয়ে সমুদ্রে টহল দিলেও বহু দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু সে সব উদ্যোগ কোথায়?
তবে ইদানীং মাইকে কিছুটা প্রচার চলে। হাওড়া জেলা থেকে আসা পর্যটক দলের সদস্য রুম্পা ঘোষ, শ্যামল বর্মনরা বলেন, “আমরা বকখালিতে আগেও এসেছি। কিন্তু সে সময় সমুদ্রে নামায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কোনও প্রচার শুনিনি। তবে এখন দেখছি, মাইকে সমুদ্রে নামার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা হচ্ছে। সারা বছর এমনটা চললে পর্যটকেরা কিছুটা সতর্ক হবেন।”
বকখালি সৈকত ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক পূর্ণচন্দ্র কুইতির দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির অভাবে পর্যটককেরা জেগে ওঠা চরে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। তা ছাড়া, দূর-দূরান্ত থেকে আসেন পর্যটকরা। তাঁরা জোয়ার-ভাটা নিয়ে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। ফলে বিপদ ডেকে আনেন। দুর্ঘটনা এড়াতে হলে সৈকত জুড়ে সারা ক্ষণ পুলিশের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও ওই চর এলাকা ঘিরে দেওয়া হলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত দু’মাস ধরে সমুদ্রে নামার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মাইকে প্রচার চলছে। সারা ক্ষণ সৈকত জুড়ে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা থাকলেও নজর এড়িয়ে দূরের সমুদ্রে চলে যান অনেকে। পর্যটকদের সর্তক করার জন্য বকখালি এলাকায় সমস্ত হোটেলে সমুদ্রে নামা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা লেখা ৫ হাজার লিফলেট বিলি করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, দুর্ঘটনা ঘটার মূল কারণ, মদ্যপ অবস্থায় জলে নামা। বেসামাল অবস্থায় কোনও পর্যটককে বারণ করলেও তাঁরা শোনেন না। এমনকী, পুলিশ বা গ্রামীণ পুলিশ কিছু বলতে গেলে উল্টে পর্যটকেরাই গালমন্দ করেন। তা ছাড়া, ফ্রেজারগজ্ঞ কোস্টাল থানায় পুলিশ কর্মী খুবই কম। ওসি-সহ মাত্র ৬ জন অফিসার। ১৩ জন কনস্টেবল। হোমগার্ড ৭ জন। এত কম সংখ্যায় পুলিশ নিয়ে থানা চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy