পরিবারের পাশে কান্তিবাবু।—নিজস্ব চিত্র।
বাঘে খেয়েছিল স্বামীকে। ছেলে মাছ ধরতে গিয়ে দু’চোখের দৃষ্টি হারাবে কিনা, সেই আশঙ্কায় দিন গোনা শুরু হয়েছে পাথরপ্রতিমার দক্ষিণ সীতারামপুরের বাসিন্দা বাসন্তী মণ্ডলের।
সুন্দরবনের আয়লা-আক্রান্ত প্রত্যন্ত এই এলাকায় মানুষের জীবন অনেকটাই নির্ভর করে জল-জঙ্গলের মেজাজ-মর্জির উপরে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাসন্তীদেবীর মতো এমন অনেককে। তাঁর ছেলে গৌরহরি তবু তো প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। উদ্ধার পেয়েছেন আরও দু’জন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মাছ ধরতে বেরিয়ে ট্রলার ডুবিতে এখনও খোঁজ নেই আরও সাত জনের।
তাঁদেরই এক জন বছর বাইশের দেবকুমার দাস। এ দিন বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল দারিদ্র্যের ছাপ সর্বত্র। আড়াই মাসের মেয়ে শুভশ্রীকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন স্ত্রী অঞ্জলি। “অনেক সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিল ও”, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। রবিন দাসের তিন মেয়ে। বড়টি পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। মেজো ক্লাস ফাইভ। ছোটটির বয়স সবে দু’বছর। সে-ও বুঝতে পারছে না, বাবা কেন বাড়ি ফেরেনি এখনও। কবেই বা ফিরবে। দেবকুমার, রবিন ছাড়াও নিখোঁজ ভগীরথ ভদ্র, শান্তনু প্রধান, বিভাস পড়িয়্যা, নিত্যানন্দ প্রামাণিক, অঙ্কুশ দাস।
কালীপদ দাস অবশ্য সুস্থ অবস্থাতেই ফিরেছেন। তিনি জানালেন শুক্রবার ভোরের অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, “আমি ঘুমিয়েছিলাম। ভোর তখন ৫টা হবে। সকলেরই চোখ লেগে এসেছিল। প্রবল হাওয়ায় হঠাত্ ট্রলারটা যেন দুলে উঠল। ঘুম ভাঙতেই দেখি, ট্রলারের ভিতরে জল ঢুকেছে।” ‘এফবি বাপ্পাই’ নামে ট্রলারটির মালিক সনত্ প্রধান। তাঁর একমাত্র ছেলে শান্তনু ওরফে বাপ্পাইয়ের নামেই ট্রলারের নাম। বাপ্পাই ছিলেন ট্রলারেই। চালাচ্ছিল তিনি নিজে। কালীপদবাবু বলেন, “হঠাত্ ট্রলারটা উল্টে গেল। আমরা সকলে জলে পড়ে গেলাম। জলের ড্রাম ধরে ভাসছিলাম আমি, গৌরহরি আর ভগীরথ। ওই অবস্থায় ঘণ্টা চারেক ভেসেছি। এক সময়ে হাত ছেড়ে তলিয়ে গেল বছর আঠারোর ভগীরথ। গৌরহরিকে কোনও মতে সামাল দিই আমি। এক সময়ে জ্ঞান হারাই। চোখ খুলল যখন, দেখলাম সীতারাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শুয়ে আছি।” সনত্বাবু বলেন, “বৃহস্পতিবারই বেরিয়েছিল ওরা মাছ ধরতে। একমাত্র ছেলেটা এগারো ক্লাসের পরে পড়াশোনা ছেড়ে মাছ ধরার কাজে নেমে পড়েছিল। ওর নামেই নাম রাখি এই ট্রলারের। ওর যে কী হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।” গৌরহরি আবার তিন ঘণ্টা সাঁতরেছেন। কিন্তু নোনা জল ঢুকে চোখের ক্ষতি হয়েছে। দেখতে পাচ্ছেন না কিছুই। তার উপরে গোটা ঘটনায় আতঙ্ক এখনও কাটেনি বছর আঠাশের যুবকের।
এ দিন প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এসেছিলেন গ্রামে। পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য করেন তিনি। গৌরহরির চোখের চিকিত্সার দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাসও দিয়ে যান। কান্তিবাবু বলেন, “এই সব হতদরিদ্র মানুষগুলি জীবিকার প্রয়োজনে গভীর সমুদ্রে যায়। বিপদ এড়াতে এদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা দরকার।” তাঁর আরও বক্তব্য, বাংলাদেশের জলসীমানার কাছাকাছি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের হাইকমিশনের সঙ্গেও যাতে উদ্ধারের ব্যাপারে যোগাযোগ করা যায়, সে জন্য প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুক।
প্রাক্তন মন্ত্রী এলাকায় ঘুরে গেলেও শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী বা প্রশাসনের কাউকে এখনও পাশে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের একাংশের। এ ব্যাপারে স্থানীয় বিধায়ক তৃণমূলের সমীর জানা বলেন, “খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা সোমবার এলাকায় যাব।”
ক্ষতিগ্রস্ত কারও যদি বিমা করানো থাকে, তার টাকা যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সে ব্যাপারেও তিনি তদ্বির করার আশ্বাস দিয়েছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিসারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জয়কৃষ্ণ হালদারের কথায়, “শনিবার পর্যন্ত স্পিড বোট নিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে কোস্টাল পুলিশ। কিন্তু কারও হদিশ মেলেনি। প্রশাসন এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগী হোক।”
এ ব্যাপারে কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিত নাথ বলেন, “দুর্ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেটি বাংলাদেশ-লাগোয়া। ফলে তল্লাশি চালাতে সমস্যা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy