বাঁ দিকে, পাঠাগারের ভিতরে সিলিং থেকে খসে পড়েছে চাঙড়। ডান দিকে, ঢোলাহাটের হরিণডাঙা সন্ধানী পাঠাগার। নিজস্ব চিত্র।
সকাল সাড়ে ১১টা। একতলা বাড়ির পাশাপাশি দুটি ঘরের একটির দরজা খোলা। ভেতরে মাঝবয়সী এক ব্যক্তি মন দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়ছেন।
কিছু প্রশ্ন করার আগেই জানালেন, ঢোলাহাটের হরিণডাঙা সন্ধানী পাঠাগারের তিনি গ্রন্থাগারিক। গ্রন্থাগারটির পরিষেবা আপাতত বন্ধ রয়েছে। বললেন, “বইপত্র কী অবস্থায় রয়েছে বা তার সংখ্যা কত, এখনও দেখা হয়নি। মাস কয়েক হল এখানে গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগ দিয়েছি। এই নিয়ে দু’টি গ্রন্থাগার আমাকে সামলাতে হচ্ছে।”
শুধু হরিণডাঙা নয়। কর্মীর অভাবে জেলার অনেক গ্রন্থাগারিককেই দু’টি করে গ্রন্থাগার সামলাতে হচ্ছে। তা ছাড়াও অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অধিকাংশ সরকারি অনুমোদিত গ্রন্থাগারই বেহাল পড়ে রয়েছে। ফলে পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাঠক।
জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, বারুইপুর, ক্যানিং ও আলিপুর এই পাঁচটি মহকুমায় গ্রামীণ ও মহকুমা বা শহর গ্রন্থাগার রয়েছে মোট ১৫৫টি। এর মধ্যে ডায়মন্ড হারবারে মহকুমা গ্রন্থাগার দু’টি ও গ্রামীণ ৩৪টি। কাকদ্বীপে মহকুমা গ্রন্থাগার ১টি, গ্রামীণ ১৭টি। বারুইপুরে মহকুমা গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৭টি, গ্রামীণ ৩৩টি। ক্যানিং মহকুমা গ্রন্থাগার ১টি, গ্রামীণ ১৭টি ও আলিপুর মহকুমা গ্রন্থাগার ৮টি, গ্রামীণ ৩৫টি। ১৯৮০-৮৫ সালের দিকে গ্রন্থাগারগুলি সরকারি অনুমোদন পায়। সেগুলি চালানোর জন্য মহকুমা গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে এক জন গ্রন্থাগারিক, এক জন সহ গ্রন্থাগারিক, এক জন বুক বাইন্ডার, ও এক জন দারোয়ান থাকার কথা। গ্রামীণ গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে এক জন গ্রন্থাগারিক ও এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থাকার কথা। এ ছাড়াও সমস্ত গ্রন্থাগারে এলাকার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পাঠ্যবই ছাড়াও পত্র-পত্রিকা রাখার কথা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি গ্রন্থাগার সপ্তাহে ছ’দিন খোলা থাকবে।
৩০-৩৫ বছর আগে গ্রামের মানুষের চাঁদায় স্থানীয় ক্লাব ঘরে বা কারও বাড়িতে বই কিনে রাখা হত। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের পাঠ্য বই ছাড়াও ক্লাবে রাখা পত্রপত্রিকার সংগ্রহ পড়তে আসত। মূলত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েরাই এতে উপকৃত হত। স্কুলের বই কেনার সামর্থ্য না থাকায়, ক্লাব থেকে বই পড়ে বা সংগ্রহ করে পড়াশোনা চালাত তারা। সে সময় সরকারি উদ্যোগ নিয়ে জেলার গ্রন্থাগারিকদের প্রতিনিধি দল ওই সমস্ত গ্রামের ক্লাবে চলা গ্রন্থাগারগুলি পরিদর্শন করে। তারমধ্যে উন্নত পরিষেবার ব্যবস্থা আছে এমন গ্রন্থাগারগুলিকে সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময়েই গ্রন্থাগারগুলিকে মহকুমা ও গ্রামীণ দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়।
কিন্তু জেলার অধিকাংশ গ্রন্থাগারে কোথাও গ্রন্থাগারিক, কোথাও বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বহু বছর ধরে নেই। ফলে এক জন গ্রন্থাগারিককে একাধিক গ্রন্থাগার সামলাতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কর্মীর অভাবে সপ্তাহের অধিকাংশ দিন বেশ কিছু গ্রন্থাগার বন্ধ থাকছে। এ ছাড়াও বহু বছর সংস্কার না হওয়ায় কিছু কিছু গ্রন্থাগার ভবনের বিপজ্জনক অবস্থা। যেমনটি দেখা গেল ঢোলাহাটের ওই গ্রন্থাগারে।
গ্রন্থাগারটি ১৯৮১ সালে সরকারি অনুমোদন পায়। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ভবনটির ছাদ ও দেওয়াল থেকে বড় বড় চাঙড় খসে পড়ছে। বর্ষার সময় ফাটল চুঁইয়ে জল ঢুকে বইপত্র ভিজে একাকার হয়। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় আলমারি থেকে বই, সব আবর্জনা ও ধুলোয় ঢাকা পড়েছে। বহু বছর ধরে নেই কোনও পরিচালন কমিটিও। গ্রন্থাগারিক কার্তিক মণ্ডল বলেন, “রায়দিঘির উষারানি মেমোরিয়াল গ্রন্থাগারটিও আমাকে চালাতে হয়। এই গ্রন্থাগারের পরিকাঠামোর অবস্থা খুবই খারাপ। কর্মীর অভাবে নিয়মিত না চলায় নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।”
একই কথা জানালেন ফলতা মালা মিলন সঙ্ঘ পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক অসিত মান্না। ১৯৮৩ সালে সরকারি অনুমোদনের পর থেকে তিনিই গ্রন্থাগারটি সামালাচ্ছেন। বললেন, “পাশাপাশি স্থানীয় হায়াতনগর সুভাষ সমিতি গ্রন্থাগারের দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়েছে। হিমসিম খাচ্ছি।” তিনি আরও জানান, গ্রন্থাগারগুলি চালু হওয়ার পর থেকে বহু বছর নতুন করে কর্মী নেওয়া হয়নি। কর্মীর অভাবে ডায়মন্ড হারবারের সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে চলা মহকুমা গ্রন্থাগারটি বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে।
বছর খানেকের মধ্যে বেশ কিছু গ্রন্থাগারিক অবসর নেবেন। তাই খুব শীঘ্রই নতুন করে কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা না করলে সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়াও বেশ কিছু গ্রন্থাগারিকের অভিযোগ, এমনিতেই এক একজনকে দু’টি করে গ্রন্থাগার সামলাতে হচ্ছে। তার উপরে আবার ভোটের বা জনসংখ্যা গণনার কাজ সামলাতে হচ্ছে বলে তাঁদের আরও সমস্যা বাড়ছে। গ্রন্থাগারের বেহাল পরিকাঠামোর জন্য সমস্যায় পড়েছেন পাঠকেরা। তাঁদের অভিযোগ, নিয়মিত পাঠাগার খোলা না থাকায় অনেককেই দূর থেকে এসেও অনেক সময়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। পাঠকদের চাহিদা মতো বই মিলছে না।
নিজস্ব ভবন পরিত্যক্ত। আপাতত ঠাঁই মিলেছে অন্যের ঘরে। তাই গত দশ মাস ধরে বন্ধ মথুরাপুর ২ ব্লকের চাপলা অগ্রণী যুবসংস্থার সাধারণ পাঠাগার। নিজেদের হাতে গড়া এই গ্রন্থাগার ১৯৮১ সালে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সরকারি এই অবহেলায় ক্ষুব্ধ চাপলা-সহ আশেপাশের প্রায় দশটি গ্রামের বাসিন্দা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক তাপসকুমার মণ্ডল অবশ্য বলেন, “বিষয়টি নজরে আছে। ওই গ্রন্থাগারের তরফে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্প জমা দেওয়া হয়নি। তা পেলেই অর্থ বরাদ্দ করা হবে।” ওই গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক প্রদীপ হালদার বলেন, “গ্রন্থাগারিকের অভাবে আট মাস গ্রন্থাগার বন্ধ ছিল। অগস্ট মাসে আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছি।” গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির সভাপতি বৃহস্পতি ভাণ্ডারী বলেন, “সরকারি অবহেলায় গ্রন্থাগারের এই দুর্দশা। সরকার ও স্থানীয় মানুষের সহযোগীতা নিয়ে গ্রন্থাগারটিকে নতুন কলেবরে সাজানোর চেষ্টা চলছে।”
জেলা গ্রন্থাগারিক জানিয়েছেন “কর্মী নিয়োগ, পরিকাঠামোর উন্নয়নের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সমস্ত দায়িত্ব ডিরেক্টর সামলান।”
তৃণমূল প্রভাবিত গ্রন্থাগারিকদের সংগঠন বঙ্গীয় সাধারণের গ্রন্থাগার ও কর্মী কল্যাণ সমিতির রাজ্য সম্পাদক রফিক শেখ বলেন, “গ্রন্থাগারিক ও কর্মীর অভাবে সারা রাজ্যে ২৫৮টি গ্রন্থাগার বন্ধ। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা সাংগঠনিক ভাবে রাজ্য দফতর ও মন্ত্রীর কাছে দরবার করেছি। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, ওই গ্রন্থাগারগুলির ৫১৬টি শূন্যপদ দ্রুত পূরণ করা হবে।
সহ প্রতিবেদন: অমিত করমহাপাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy