রবীন্দ্র সদনে রাজ্য চারুকলা উৎসবে কৃতী শিল্পীদের পুরস্কার প্রদানের আসরে শিল্পী যোগেন চৌধুরী এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রেক্ষাগৃহ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সেই সঙ্গে মঞ্চ জুড়ে চিত্রশিল্পী, ভাস্করদের ছড়াছড়ি। তার মাঝেও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বড় হয়ে উঠল ‘প্রিয় শিল্পী’র অনুপস্থিতি।
মঙ্গলবার দুপুরে রবীন্দ্রসদনে রাজ্য চারুকলা উৎসবে কৃতী শিল্পীদের পুরস্কারপ্রদানের আসরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন তথা ‘শুভাদা’র খোঁজে। মাস তিনেক আগেও একটি সভায় যাঁর নামটি তিনি মনে করতে পারেননি! এ দিন অবশ্য বক্তৃতার ফাঁকে মুখ্যমন্ত্রী আক্ষেপ করেছেন, “শুভাদা আসেননি! কেন আসেননি, জানি না! সবাই এলে ভাল লাগে।”
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-জমানা পত্তনের গোড়া থেকেই শুভাপ্রসন্ন কার্যত সরকারি অনুষ্ঠানে মমতার ছায়াসঙ্গীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। প্রথম ছন্দপতন গত নভেম্বরে, যখন সারদা কেলেঙ্কারি ঘিরে শুভাপ্রসন্নের দিকে সবে ইডি-সিবিআইয়ের আঙুল উঠেছে। প্রিয় শিল্পী তথা সুহৃদ সম্পর্কে মমতা তখন বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বার বার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শুভাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে তিনি তৎপর। এমনও বলেন, ‘শিল্পী’ শুভাপ্রসন্ন ও ‘ব্যবসায়ী’ শুভাপ্রসন্ন তাঁর কাছে এক নয়। পৈলানের এক কর্মিসভায় শুভা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আইন আইনের পথে চলবে।’
আর নভেম্বরে নেতাজি ইন্ডোরের কর্মিসভায় তো শুভাপ্রসন্নের নামটাই মুখ্যমন্ত্রী ‘ভুলে’ গিয়েছিলেন! ‘শিল্পী, কী যেন নাম’ এটুকু বলেই মমতা সে দিন জানিয়ে দেন, উল্লিখিত ব্যক্তির ব্যবসায়িক কাজকর্মের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই।
এমতাবস্থায় দু’জনকে একমঞ্চে শেষ বার দেখা গিয়েছে নভেম্বরের গোড়ায়, নজরুল মঞ্চের এক সরকারি অনুষ্ঠানে। সেখানে তাঁদের বিশেষ বাক্যালাপ হয়নি। তার পরে শুভা-মমতা কখনও এক সঙ্গে প্রকাশ্যে আসেননি। চলচ্চিত্র উৎসব হোক বা সঙ্গীতমেলার আসর--- মুখ্যমন্ত্রীর ত্রিসীমানায় ছিলেন না শুভাপ্রসন্ন।
তবে ওঁদের সম্পর্কে ফের পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে। তখনই আভাস মেলে, শুভার বিষয়ে মমতার শীতল মনোভাবের বরফ গলছে। দীর্ঘ দিন বাদে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ‘শুভা’ নাম শোনা যায় তাঁর ঢাকা সফরের আগে, বিড়লা তারামণ্ডলের কাছে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। মমতা সেখানে ঘোষণা করেন, দেশপ্রিয় পার্কে ভাষা-দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে শুভাদা থাকবেন। শুভা অবশ্য যাননি। সরকারি অনুষ্ঠানের কার্ডে নাম ছাপা সত্ত্বেও।
তার পরেও এ দিন ফের ‘শুভাদা’র নাম মমতার মুখে!
অথচ সিবিআই-ইডি এখনও শুভাপ্রসন্নের সারদা-যোগ নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ: সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে শুভা সাড়ে ছ’কোটি টাকায় বেচেছিলেন তাঁর সংবাদ চ্যানেল, যা কিনা কোনও দিন চালুই হয়নি। শিল্পীর একাধিক ফ্ল্যাট ও অন্যান্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে টাকাটা উদ্ধার করার পরিকল্পনা রয়েছে তদন্তকারীদের। শুভার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইতিমধ্যে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এবং প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিস্থিতিতেও নেত্রী কেন ফের শুভার হাত ধরতে চাইছেন?
মমতার ঘনিষ্ঠ মহল-সূত্রে জানা যাচ্ছে, সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে শিল্পীর সরাসরি যোগাযোগ এখনই প্রমাণ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে দলের একাংশ মনে করছে। নেত্রীও চাইছেন শুভাকে ফের কাছে টেনে দলে আত্মবিশ্বাসের বার্তা দিতে। নেত্রীর ‘শুভা-প্রীতি’র মধ্যে শাসকদলের একটি মহল অন্য একটা কারণও দেখছে। সেটা কী?
এই মহলের ব্যাখ্যা: ‘শিল্পী’ মমতাকে চিত্রমোদীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা দিতে একদা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন যোগেন চৌধুরী (বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ) ও শুভাপ্রসন্ন। এ দিকে সিবিআই ইতিমধ্যে শুভাকে ডেকে জানতে চেয়েছে, মমতার আঁকা ছবি লক্ষাধিক টাকায় বিকোল কোন যুক্তিতে? “শুভাপ্রসন্ন এ বিষয়ে তদন্তকারীদের কী বলেন, তা নিয়েও নেত্রীর মনে আশঙ্কা থাকতে পারে। হয়তো এ সব চিন্তা করেই তিনি আবার পুরনো সম্পর্কের গোড়ায় জল ঢালছেন।” পর্যবেক্ষণ তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার।
তা হলে শুভা কেন দূরে দূরে? অনুষ্ঠানে তিনি এলেন না কেন?
শিল্পীকে এ দিন ফোন করে সাড়া মেলেনি। এসএমএস করে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও জবাব আসেনি। যদিও শিল্পীমহলের খবর, প্রকাশ্য বিরাগপোষণের জন্য নেত্রীর প্রতি শুভার মনে দুস্তর অভিমান জমেছে, যা তিনি এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এই কারণে গত সপ্তাহে চারুকলা উৎসব শুরুর পরে উদ্বোধনী-আসরেও যাননি। সে দিন অবশ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন থাকায় মমতা নিজেও আসতে পারেননি।
দু’বছর আগে টাউন হলে মমতার আঁকা ছবির প্রদর্শনী আয়োজনে তাঁর ‘শুভাদা’রই ছিল মুখ্য ভূমিকা। সেখানে ছবির দাম বেঁধে দেওয়া হয় এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ টাকায়। ‘স্ব-শিক্ষিত, স্বতঃস্ফূর্ত’ শিল্পী মমতাকে প্রশংসার শিখরে চড়িয়ে দেন তাঁর ‘শুভাদা’ ও ‘যোগেনদা।’
এ দিনের অনুষ্ঠানের বক্তৃতাতেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “শিল্পীর শিল্পী-সত্তা শিখে তৈরি হয় না। সেটা নিজে থেকে হয়। কারও তুলি-কলম আপনি চলতে শুরু করে। স্পন্টেনিয়াস (স্বতঃস্ফূর্ত)!”
শিল্পীমহলের অনেকের ধারণা, মমতা এখানে প্রকারান্তরে নিজের কথাই বলতে চেয়েছেন। আর শিল্পীর ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ প্রসঙ্গে ওঁর মন্তব্যের মধ্যে যেন তাঁর ছবি সম্পর্কে ‘শুভাদা’র সেই অতীত মূল্যায়নেরই প্রতিধ্বনি!
সব মিলিয়ে এ দিন রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে না-এসেও শুভাপ্রসন্ন হাজির ছিলেন পুরোদস্তুর। তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ‘দেখা’টাই শুধু হল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy