মজুতদার শুধু নয়, দক্ষ নির্মাতাও। বর্ধমানের বাদশাহি রোডের বাড়িতে বোমার গুদাম পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে রেজাউল করিম নিজেও বিস্ফোরক ও গ্রেনেড বানাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত রেজাউল শনিবার সকালে ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে এনআইএ-র হাতে ধরা পড়ার পরে আইবি-সহ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাকে দফায় দফায় জেরা করেছে। জেরায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারীদের দাবি, খাগড়াগড়ের বাড়িটিতে জঙ্গিরা বিস্ফোরকের যে ‘কারখানা’ গড়ে তুলেছিল, সেখানেই রেজাউলের নাশকতা-বিদ্যায় হাতেখড়ি। তাকে তালিম দিয়ে দিয়ে বোমা-গ্রেনেড তৈরির দস্তুরমতো পাকা কারিগর বানিয়ে তুলেছিল সেই শাকিল আহমেদ, খাগড়াগড় বিস্ফোরণে যার জীবনান্ত হয়।
গোয়েন্দারা জানান, বাদশাহি রোডে রেজাউলের বাড়ির আধ কিলোমিটার দূরে খাগড়াগড়ে শাকিলদের ডেরাটি গবেষণাগার তথা কারখানার পাশাপাশি নাশকতার প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে রেজাউল কবুল করেছে। “এতেই স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে বসা জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) চাইছিল এখানে যত বেশি সংখ্যক বোমারু তৈরি করতে।” মন্তব্য এক গোয়েন্দার।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর: জেএমবি-র যে মডিউল বা গোষ্ঠীর উপরে পশ্চিমবঙ্গে বসে গ্রেনেড, আইইডি, রকেট লঞ্চার ইত্যাদি বানানোর ভার, তার অন্দরে রেজাউল ‘মিস্ত্রি’ নামে পরিচিত। রাজমিস্ত্রির কাজের সূত্রেই মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের ছেলে রেজাউলের বর্ধমানে আগমন। তার বাবাও পেশায় রাজমিস্ত্রি। বছর তিনেক আগে জঙ্গি-চক্রে সামিল হওয়া রেজাউল বিবিধ ‘দক্ষতা’র প্রমাণ দিয়ে অচিরে সংগঠনের নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠে। এক তদন্তকারী বলেন, “খাগড়াগড়ে তৈরি বোমার বহর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার আগে সেগুলোর অধিকাংশ রেজাউলের বাদশাহি রোডের বাড়িতে মজুত করা হতো। এতেই বোঝা যাচ্ছে, মডিউলে রেজাউলের গুরুত্ব কতটা ছিল।” খাগড়াগড়ের মতো বিভিন্ন জঙ্গি ডেরা থেকে আসা বিস্ফোরকের চালান কোন কোন পথ ধরে, কোথায় কোথায়, কী ভাবে পাচার করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে রেজাউলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার আশায় রয়েছেন গোয়েন্দারা। এনআইএ-সূত্রের খবর: রেজাউলকে আজ, সোমবার অথবা কাল মঙ্গলবার কলকাতায় এনে কোর্টে পেশ করা হতে পারে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তাকে দীর্ঘ সময় জেরা করেছেন। আইবি-সূত্রের দাবি: খাগড়াগড়-কাণ্ডে বিভিন্ন সন্দেহভাজনের ছবি রেজাউলকে দেখানো হয়েছে, এবং তাদের এক জনকে সে চিহ্নিত করেছে কওসর হিসেবে, যাকে কিনা বাংলাদেশের পুলিশ ‘বোমা মিজান’ নামে চেনে। বোমা মিজান ও কওসর যে একই লোক, বাংলাদেশের তরফে সেটা অবশ্য এনআইএ-কে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রেজাউলের কথায় গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হয়েছেন। এক তদন্তকারীর মন্তব্য, “রেজাউল ছিল কওসরের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। খাগড়াগড়-তদন্তে কওসর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিস্ফোরণের পরে কওসর কোন পথে গা ঢাকা দিয়েছে, রেজাউল সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারে।”
পাশাপাশি জিহাদি সন্ত্রাস-চক্রে জেএমবি’র পশ্চিমবঙ্গ মডিউলের আর এক সদস্য জিয়াউল-হকের ঠিক কী ভূমিকা ছিল, সে বিষয়েও রেজাউল বাড়তি তথ্য জোগাতে পারে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। কালিয়াচকের বাসিন্দা তথা বর্ধমানের এক হাইস্কুলের আরবি ভাষার শিক্ষক জিয়াউলকে গত ৭ নভেম্বর এনআইএ গ্রেফতার করে— খাগড়াগড়-তদন্তে এনআইএ-র প্রথম গ্রেফতারি। তদন্তকারীরা জানান, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে রেজাউল একটা ল্যাপটপ জিয়াউলের হেফাজতে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। ল্যাপটপটি এনআইএ উদ্ধার করেছে।
রেজাউল-জিয়াউল যোগাযোগ হল কী ভাবে? গোয়েন্দামহলের ব্যাখ্যা: দু’জনে বর্ধমানের একই মসজিদে নমাজ পড়ত। সেই সূত্রে পরিচয়। রেজাউলের মুখে শিমুলিয়া মাদ্রাসার কথা শুনে জিয়াউল নিজের বোনকে মালদহ থেকে এনে সেখানে ভর্তি করে। আবার শিমুলিয়া মাদ্রাসার সূত্রেই জিয়াউল ইউসুফ-বোরহান শেখ-সাজিদের মতো জেএমবি-চাঁইদের সান্নিধ্যে আসে। নিজেও ক্রমশ সংগঠনে জড়িয়ে জিহাদি মতাদর্শ প্রচারে বড় ভূমিকা নেয়। একাধিক বার বাংলাদেশে গিয়ে জেএমবি-র নেতাদের সঙ্গে সে বৈঠকও করে। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “রেজাউল বলতে পারবে, জেএমবি-র মডিউলে জিয়াউল নিছক প্রচারক ছিল, নাকি আরও বেশি কিছু।” জিয়াউলের মতো আরও কত শিক্ষিত যুবক জঙ্গিদের সঙ্গে রয়েছে, রেজাউলের কাছে তারও আন্দাজ পেতে চাইছেন ওঁরা। এমএ পাশ জিয়াউল যাতে জেলে বসে বিএড পরীক্ষা দিতে পারে, আদালত সে জন্য রাজ্য কারা দফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy