কেন্দ্রীয় সরকার জঙ্গি সংগঠন হিসেবে স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়াকে (সিমি) নিষিদ্ধ করার পরেও রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান যে বছরের পর বছর ওই সংগঠনের মাথা হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন সে বিষয়ে বহু তথ্যপ্রমাণ হাতে এসেছে বলে দাবি করেছে এনআইএ-র সূত্র।
ইমরান এর আগে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তিনি সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে একটা সময়ে দায়িত্বে থাকলেও কেন্দ্র সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার পরে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, তাঁদের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, ইমরানের এই দাবি শুধু অসত্যই নয়, সিমি-র কৌশলের অঙ্গও।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে ভারতীয় জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি জামাতে ইসলামির যোগাযোগের বিষয়টি নিয়েও তত্ত্বতালাশ শুরু করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এ কাজে ভারতের অন্য গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থাগুলি ছাড়া বাংলাদেশের গোয়েন্দাদেরও সাহায্য নিয়েছে এনআইএ। বিভিন্ন মাধ্যমে হাতে আসা আট থেকে ন’টি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে এনআইএ সূত্রের দাবি সিমি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ার পরও পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বেনামে কার্যত সংগঠন পরিচালনার কাজটাই করতেন ইমরান। বাংলাদেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে সিমি-র যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি-ই।
কেন এই কথা বলছেন গোয়েন্দারা?
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ইলিয়ট রোডে তাঁর ‘কলম’ পত্রিকার অফিসেই সিমি নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতেন ইমরান। নিষিদ্ধ হওয়ার পাঁচ বছর পরে ২০০৬ সালের ১৮ জুন ‘কলম’ অফিসে ইমরানের উপস্থিতিতেই সিমি নেতারা এমন একটি বৈঠক করেন। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে রাজ্যে কী ভাবে কাজে নামা যায়, তার পন্থা ঠিক হয় এই বৈঠকে। দিল্লি ও আলিগড় থেকে আসা নেতাদের পাশাপাশি কলকাতা, আসানসোল ও মুর্শিদাবাদের সিমি নেতারাও ছিলেন সেখানে। গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, সেই বৈঠকেই বেনামে চারটি নতুন সংগঠন খোলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। কৌশল হিসেবে ঠিক হয়, সব প্রাক্তন নেতাই বলবেন, সিমি-র সঙ্গে তাঁদের আর কোনও সংশ্রব নেই। নতুন সংগঠন গড়ে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কাজে নেমেছেন তাঁরা। গোয়েন্দাদের দাবি, তৃণমূল সাংসদ এখনও সেই কৌশল নিয়েই চলেছেন।
কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার পাঁচ বছর পরে কেন ঘুম ভাঙল সিমি নেতাদের?
গোয়েন্দা সূত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ২০০১-এ সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে গোয়েন্দারা খুবই সক্রিয় ছিলেন। গ্রেফতারি এড়াতে তখন গা-ঢাকা দেন সিমি নেতারা। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারি ক্রমেই ঢিলে হতে থাকে। সেই সুযোগে ২০০৬-এর শুরু থেকেই সিমি নেতারা ফের প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করতে থাকেন। এই সময়েই বাংলাদেশের জামাতে ইসলামির সঙ্গে যোগাযোগ করে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন রাজ্যের সিমি নেতারা। গোয়েন্দাদের দাবি, বাংলাদেশের জামাত শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ থাকার কারণে এই গুরুদায়িত্বও বর্তায় ইমরানের ওপর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ছ’দিন পরে ১৭ সেপ্টেম্বর সিমি-কে জঙ্গি সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেন্দ্র। কিন্তু তদন্ত-সংস্থা সূত্রের দাবি, তার বহু বছর পর পর্যন্ত ইমরান বাংলাদেশ ও ভিন্ রাজ্যের সিমি নেতাদের কলকাতায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। অন্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এ বিষয়ে এনআইএ-কে লিখিত রিপোর্ট দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সিমি-র নেতাদের সঙ্গে ইমরান যে সব বৈঠক করেছেন, সে সম্পর্কেও সবিস্তার তথ্য রয়েছে এই রিপোর্টে। তাতে বলা হয়েছে, দিল্লির নেতা মনসুর আহমেদ, কাসেম রসুল ইলিয়াস, আলিগড়ের আমানুল্লা খান ইমরানের পত্রিকার দফতরে বসেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার সিমি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। মুর্শিদাবাদের তাইদুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ, লালগোলার সৈয়দ সাহাবুদ্দিন ও আসানসোলের জুবাইদ আহমেদ বা গোলাম মহম্মদের মতো তথাকথিত প্রাক্তন সিমি নেতারা কলকাতায় এসে ইমরানের আশ্রয়ে থাকতেন। বৈঠকেও সামিল হতেন।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের দাবি অনুযায়ী, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জামাত ও ভারতের সিমি নেতাদের মধ্যে চারটি বৈঠক হয়। ২০০৬ সালের ২১ মে পার্ক স্ট্রিট, ১৬ জুলাই সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউ এবং ২৩ অগস্ট জওহরলাল নেহরু রোডের তিনটি ঠিকানায় তিনটি বৈঠক হয়। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ১২ অগস্ট একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নামের আড়ালে মৌলালি যুব কেন্দ্রে একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকগুলিতে একাধিক জামাত ও সিমি নেতা উপস্থিত ছিলেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ইমরান যে বছরে একাধিক বার করে বাংলাদেশে যেতেন, এবং সেখানকার জামাতের শীর্ষ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতেন, এমনকী তাঁদের থেকে মোটা অর্থ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা সে বিষয়টিও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্ট দিয়েছেন।
খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর (জেএমবি) জাল ছড়ানোর বিষয়টি সামনে আসে। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, জেএমবি-র সঙ্গে ও-দেশের মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে জেএমবি-র জাল ছড়ানোয় ভারতের সিমি-র যোগসাজশের বিষয়টি এনআইএ-র তদন্তে উঠে এসেছে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সিমি কেন্দ্রীয় ভাবে ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’ নামে নাশকতা চালালেও পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে তারা বকলমে অন্তত চারটি সংগঠন চালায়। এই চারটি সংগঠনেই মুখ্য সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন ইমরান। তাঁর মতো সিমি-র আরও কিছু প্রাক্তন নেতাও এই সংগঠনগুলিতে যুক্ত হন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তাঁরা আরও দাবি করছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা এনে জঙ্গিদের মধ্যে বিলির কাজটিও সিমি-র এই প্রাক্তন নেতারা করতেন। ইতিমধ্যে এমন কয়েক জন চাঁইকে আটক করা হয়েছে, জানান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। জেরায় তাঁরা ইমরানের বিষয়েও নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের গোয়েন্দা বিভাগও দীর্ঘদিন ধরে ইমরানকে সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করে তাঁর গতিবিধির ওপর নজরদারি চালিয়েছে। ২০০২-এর ২ মার্চ নাইমুল হক নামে এক সিমি নেতা হাওড়া স্টেশনে জিআরপি-র হাতে ধরা পড়ে। তার কাছ থেকে সিমি-র বেশ কিছু নথি, জেহাদি প্রচার পুস্তিকা ও সিডি উদ্ধার হয়। সেই জঙ্গিকে জেরা করে ইমরানের বিষয়েও অনেক তথ্য মিলেছিল।
ইমরান সিমির প্রতিনিধি হিসেবেও একাধিক বার বাংলাদেশে গিয়ে ওখানকার জামাত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ২০০৫ সালের ২ এপ্রিল ইমরান দু’দিনের জন্য বাংলাদেশে যান। ওই সফরে তিনি বাংলাদেশের একাধিক জামাত নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মির কাসেম আলি, একাত্তরে গণহত্যার দায়ে যাঁকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আদালত। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে সিমি-কে ফের চাঙ্গা করতে বহু টাকা ঢেলেছিলেন এই জামাত নেতা। ইমরান তাঁর সাপ্তাহিক ‘কলম’ পত্রিকাটি শুরু করেছিলেন সিমি-র মুখপত্র হিসেবেই। এই পত্রিকাটিকে দৈনিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মির কাসেমের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন বলেও গোয়েন্দারা দাবি করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সেই সময়ে এই জামাত নেতা মির কাসেমকে কলকাতায় নিয়ে এসে তিনি সংবর্ধনাও দিয়েছিলেন।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, ২০০৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েক জন জামাত নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ইমরান চেন্নাই ও বেঙ্গালুরু যান। গোয়েন্দা কর্তাদের অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকে ওই দুই শহরে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা সিমি নেতাদের সঙ্গে জামাত নেতাদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন ইমরান। শুধু বাংলাদেশই নয়, ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির মাধ্যমে লন্ডন ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকেও ইমরান প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আনিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দারা দাবি করছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির বিষয়ে ইমরানের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব মেলেনি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানান, অন্তত ২০ বছর ধরে ইমরানের গতিবিধির ওপর তাঁরা নজরদারি চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের গোয়েন্দারাও তাঁকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে বহু বার ইমরানের বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে রিপোর্ট দিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও কেন তাঁকে এত দিন আটক করেনি পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ? এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের এক কর্তার ব্যাখ্যা অনেক সময়ে কাউকে গ্রেফতারের চেয়ে তাঁকে ছেড়ে রেখে গতিবিধির ওপরে নজরদারি চালিয়ে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এই কারণেই ইমরানকে কখনও গ্রেফতার করার দরকার পড়েনি বলে তাঁর অভিমত। তবে ভারত ও বাংলাদেশের প্রশাসন ইমরান সম্পর্কে বরাবরই সজাগ ছিল বলে ওই গোয়েন্দাকর্তার দাবি।
ইমরানের মতো সন্দেহভাজন এক জনকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি করে পাঠালে কেন্দ্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও বিস্মিত হয়। বাংলাদেশের মৌলবাদী-জঙ্গি শক্তির সঙ্গে ইমরানের দহরম-মহরমের অভিযোগ এনে বিদেশ মন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়ে তাদের অপ্রসন্নতার কথা জানিয়েছিল ঢাকা। নবান্ন সূত্রের খবর, ইমরানকে প্রার্থী করার পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী কলকাতায় এসে তাঁর সন্দেহজনক কাজ নিয়ে মমতার হাতে গোয়েন্দা-রিপোর্ট সংবলিত একটি ফাইল তুলে দেন। প্রার্থী বদলের জন্য মমতাকে আর্জিও জানিয়ে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। কিন্তু তা কানে তোলেননি মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy