ভোট মিষ্টি। দক্ষিণ কলকাতার একটি দোকানে প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।
গোটা রাজ্যে এই মুহূর্তে তাদের এক জন বিধায়কও নেই। সারা রাজ্যে কোথাও তাদের হাতে নেই কোনও পুরসভা। আছে বলতে সাকুল্যে তিন-চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পদ!
এ হেন বিজেপি-র হাতেই এ বার এ রাজ্যে লোকসভা ভোটের চাবিকাঠি! ডান-বাম মিলিয়ে রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলের অন্দরের ভাবনাচিন্তা এমনই। দেশে নরেন্দ্র মোদীর হাওয়ায় বঙ্গে গেরুয়া বাহিনীর ভোট বাড়বে, ভোটযন্ত্র খোলার আগেই সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত সব মহল। ভোটের আগে জনমত সমীক্ষা এবং ভোটের পরে বিভিন্ন বুথ-ফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিতও একই রকম। যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটতে শুরু করবে আজ, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে। যখন শুরু হবে রাজ্যের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের ভোট-গণনা। রাজ্যে এ বারই প্রথম উত্তেজক চতুর্মুখী লড়াই। আজ দুপুরের পরপরই স্পষ্ট হয়ে যাবে তার ফয়সালা। তার আগে সব শিবিরে এখন উৎকণ্ঠা, কার বাক্স থেকে কত ভোট কাটবে বিজেপি!
নানা সমীক্ষা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, রাজ্যে এ বার বিজেপি-র ভোট গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১৩ বা ১৪%-এ। সচরাচর এখানে বিজেপি-র ভোট গড়ে ৫-৬%। এর আগে রামমন্দিরের হাওয়ায় ১৯৯১ সালে এক বার তাদের ভোট ১০% ছুঁয়েছিল। তার পরে ২০১২ সালে জঙ্গিপুরে লোকসভা উপনির্বাচনেও তারা পেয়েছিল ১০% ভোট। তখন যেমন মোদী-হাওয়া ছিল না, উল্টো দিকে আবার তৃণমূলের প্রার্থীও ছিল না। এ বার যদি বিজেপি শেষ পর্যন্ত সেই রেকর্ড ছাপিয়ে যায়, রাজ্য রাজনীতির সমীকরণে তার প্রভাব অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে। বিশেষত, দু’বছর পরের বিধানসভা ভোটের চালচিত্র হবে অন্য রকম। মোদী-হাওয়ায় ১৮ থেকে ৩০ বছরের তরুণ ভোটারদের মন জয়ের ব্যাপারে এ বার প্রবল আত্মবিশ্বাসী বিজেপি। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনে দার্জিলিং আসনটি ধরে রাখা ছাড়া বাড়তি কত আসন তারা পেতে পারে, সেই প্রশ্নে অবশ্য নানা রকম ইঙ্গিত মিলেছে সমীক্ষা থেকে। দুই থেকে ৬টি পর্যন্ত আসন বিজেপি-কে দেওয়া হয়েছে হরেক রকম সমীক্ষায়। কিন্তু যে প্রশ্নে কারওরই সংশয় নেই, সেটা হল জিতুক বা না জিতুক, বহু ক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি করে দিতে পারে বিজেপি-ই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের ভোট কাটতে পারে বিজেপি? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, তরুণ প্রজন্ম এবং দোদুল্যমান ভোটারদের বড় অংশই গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে বামেদের পাশ থেকে সরে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র পক্ষে নতুন সরকারের কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষাও বেশি ছিল এই অংশের। এখন মোদী-হাওয়ায় এই অংশেরই উন্মাদনা বেশি। কাজেই বিজেপি-র ভোটবৃদ্ধির পিছনে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে ক্ষয়ের সম্ভাবনাই স্বাভাবিক ভাবে যুক্তিগ্রাহ্য। এর বাইরে বাম এবং কংগ্রেসের দিক থেকেও কিছু ভোট বিজেপি-র দিকে যেতে পারে। তবে সব রকম ভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ভোট বাম বা কংগ্রেস পেয়েছিল, তার চেয়েও জনসমর্থন কমে যেতে পারে কি না, তা নিয়ে নানা রকমের সম্ভাবনার তত্ত্ব আছে। তার মধ্যে কোনটা ঠিক, উত্তর মিলবে আজ গণনা-টেবল থেকেই।
বিজেপি-র কাছে এ বারের ভোট যদি হয় প্রভাব বাড়ানোর, রাজ্যের শাসক দলের কাছে ভোট তা হলে
প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার। বস্তুত, তৃণমূলের জন্মের পরে এ বারই প্রথম কোনও সাধারণ নির্বাচনে একক ভাবে লড়াই করছে তৃণমূল। অতীতে তারা কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেস কোনও না কোনও সর্বভারতীয় দলের সঙ্গে জোট গড়ে ভোটে লড়েছে। এ বার তাদের লক্ষ্য, একক ভাবে লড়েও রাজ্যে যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, এটাই প্রমাণ করা। যে জন্য দলের অন্দরের আলোচনায় তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের একাংশের প্রাথমিক লক্ষ্য অন্তত ২৬টি আসন জয় করা। গত বার লোকসভা ভোটে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং এসইউসি মিলে জোটে ২৬টি আসন পেয়েছিল। একক ভাবে অন্তত সেই সংখ্যায় আসন পেলে তৃণমূল বোঝাতে পারবে, কারও সাহায্য ছাড়া তারা একাই একশো! বিভিন্ন সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত তৃণমূলকে ২০ থেকে ৩১ পর্যন্ত যে কোনও সংখ্যক আসন দিয়েছে। গত পঞ্চায়েতে অবশ্য একক ভাবেই আধিপত্য পেয়েছে তৃণমূল। কিন্তু পঞ্চায়েত আর লোকসভা ভোট যে রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে তুলনীয় নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
ভোটের প্রচারে তৃণমূল নেত্রী মমতা এ বার আগাগোড়া বলে এসেছেন, কেন্দ্রে সরকার গঠনে তাঁদের নির্ণায়ক ভূমিকা থাকবে। কাজেই আসন-সংখ্যার পাশাপাশি সেই লক্ষ্যে তৃণমূল নেত্রী পৌঁছতে পারলেন কি না, সেই দিকেও আজ নজর থাকবে।
নিজস্ব পরিধির মধ্যে সব দলের কাছেই এ বারের ভোট প্রকৃতপক্ষে এক এক রকমের পরীক্ষা। বামেদের যেমন প্রাথমিক লক্ষ্য, গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক রক্তক্ষরণ রোধ করা। পাঁচ বছর আগে লোকসভা ভোটে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ১৫টি আসন। তার দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল সাতে। গত পঞ্চায়েত ভোটকে মাপকাঠি ধরলে সংখ্যাটা কয়েকটিতে দাঁড়ায়। পঞ্চায়েত ভোটকে অবশ্য নিরপেক্ষ বলে মানতে নারাজ কোনও বিরোধী দলই। তবু শাসক দলের সন্ত্রাস, তাণ্ডবের অভিযোগ যে সব এলাকায় বেশি, সেখানে বামেরা পেয়েছিল ৩৬-৩৮% ভোট। যেখানে সন্ত্রাসের অভিযোগ অপেক্ষাকৃত কম, সেখানে তারা ৪০% ভোটও পেয়েছিল। এখন বামেদের সামনে প্রথম লক্ষ্য, ওই ৩৬% ভোট ধরে রাখা। তাতে যতগুলি আসন আসে, আসবে।
আবার কংগ্রেসের কাছে প্রথম লক্ষ্য, তাদের হাতে-থাকা ৬টি আসন ধরে রাখা। উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের দাপট অক্ষুণ্ণ আছে কি না, তার প্রমাণ মিলবে ওই ৬টি আসনের ফল থেকেই। এর পরে কংগ্রেসের লক্ষ্য, রাজ্যের অন্যত্র কিছু ভোট পেয়ে রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখা। জোট ভেঙে যাওয়ার পরে কংগ্রেসের অনেক নেতাই একান্তে বলেছেন, লোকসভায় বেশ কিছু আসনে তাদের জন্য শাসক দল হেরে গেলে তবেই তৃণমূলকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া যাবে! কংগ্রেস শেষ বার এ রাজ্যে একা লড়ে ২০০৬-এর বিধানসভায় পেয়েছিল প্রায় ১৬% ভোট। তার আগে ২০০৪-এর লোকসভায় তারা ভোট পেয়েছিল প্রায় ১৪%। এ বার কংগ্রেস ওই রকম ভোটই পেতে পারে বলে দেখিয়েছে বুথ-ফেরত সমীক্ষাগুলি। তৃণমূলের ধাক্কায় দলে প্রবল ভাঙনের মুখে বাস্তবে তেমন ভোট পেলে স্বস্তি পেতে পারেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
এই বৃহত্তর চিত্রের বাইরে আরও কিছু ছোট ছোট পরীক্ষাও হচ্ছে এ বার। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় যেমন দেব, মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, সৌমিত্র রায়, ইন্দ্রনীল সেন, অর্পিতা ঘোষেরা আছেন, বিজেপি-র তালিকাতেও তেমন আছেন বাপ্পি লাহিড়ী, বাবুল সুপ্রিয়, জর্জ বেকার, পি সি সরকারের (জুনিয়র) মতো তারকারা। নির্বাচনী ময়দানে তাঁদের অভিষেক কেমন হয়, জানা যাবে আজ। ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ বার সোমেন মিত্রের ছেড়ে-যাওয়া ডায়মন্ড হারবার আসনে টিকিট দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর যাত্রা মসৃণ ভাবে শুরু হবে কি না, বোঝা যাবে আজই। সাম্প্রতিক কালে দল-বদলানো একাধিক বিধায়ককে এ বার তৃণমূলের টিকিটে লোকসভা এবং বিধানসভা উপনির্বাচনে দাঁড় করিয়েছেন মমতা। জার্সি বদলে তাঁরা ফের জনতার আস্থা অর্জনে সমর্থ হলেন কি না, তা-ও জানা যাবে আজ।
আপাতত জল্পনা এবং উৎকণ্ঠার রাত পোহানোর আগে সব দলই মোটামুটি একটি বিষয়ে একমত। চতুর্মুখী লড়াইয়ে জয়-পরাজয়ের মীমাংসা হয়তো হবে অল্প ব্যবধানে। লোকসভা-সুলভ লক্ষাধিক ভোটে নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy