সোমবার রাজভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন বিজেপি সদস্য রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
পাড়ুইয়ের বিজেপি সমর্থক পরিবারের এক বধূর উপরে পুলিশ ও শাসক দলের বর্বর অত্যাচারের যুগলবন্দির খবরে আরও এক বার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন। তবে অন্য অনেক ঘটনার মতো একে প্রথমেই ‘ছোট ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিতে পারছে না প্রশাসন। বরং এই ঘটনায় হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা ও রাজ্যপালের প্রতিক্রিয়া কিছুটা চাপেই ফেলেছে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে।
নির্যাতনের ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্ট সোমবার নিজে থেকেই মামলা গ্রহণ করেছে। আজ, মঙ্গলবার যার শুনানি হতে পারে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে। এরই পাশাপাশি বিজেপির দাবি, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী নিজে পুলিশের ডিজি-কে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিজেপি।
প্রবল চাপের মুখে নির্যাতনে অন্যতম অভিযুক্ত বীরভূম জেলা পুলিশের ওসি (স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ) কার্তিকমোহন ঘোষকে এ দিন ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে। বীরভূমের এসপি অলোক রাজোরিয়া সিউড়িতে সাংবাদিকদের বলেন, “অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়কে দিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছি। রিপোর্ট পেলেই, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। ওই সময় কালের জন্য সাব-ইনস্পেক্টর কার্তিকমোহন ঘোষকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।”
তবে এতেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হতে পারছে না বীরভূম পুলিশ। রবিবার রাতে পাড়ুই থানায় প্রথম লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন নির্যাতিতার স্বামী। তাতে কোনও পুলিশকর্মী বা পুলিশকর্তার নাম ছিল না। সোমবার রাতে তিনি দ্বিতীয় অভিযোগটি করেছেন পাড়ুই থানায়। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনায় কার্তিকমোহনের সঙ্গে এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষ, সিআই (বোলপুর) চন্দ্রশেখর দাস এবং ওসি (ইলামবাজার থানা) মহম্মদ আলিও জড়িত। তবে, পাড়ুই থানা এই অভিযোগটি নিলেও তাতে স্ট্যাম্প মারেনি। ফলে এই অভিযোগ অনুযায়ী কতটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে নির্যাতিতার পরিবার।
তবে কলমডাঙায় পুলিশি অভিযানে সামিল এক পুলিশকর্মী জানিয়েছেন, কার্তিকমোহন তাঁদের সঙ্গে অভিযানে ছিলেন। তবে জেলা পুলিশের বিশেষ দলটি অভিযান চালিয়েছে বোলপুরের এসডিপিও অম্লানকুসুম ঘোষের নেতৃত্বে। তাঁরই গাড়িতে তুলে ওই বধূকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। দলে কোনও মহিলা পুলিশ ছিল না বলে নির্যাততা দাবি করলেও ওই পুলিশকর্মীর দাবি, এক জন মহিলা পুলিশকর্মী ছিলেন দলে।
একেই বীরভূমে পুলিশের বিরুদ্ধে বারবারই রাজনৈতিক পক্ষপাত ও অত্যাচারের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। শনিবারের ঘটনা যারপরনাই অস্বস্তিতে ফেলেছে জেলা পুলিশকে। রাজ্য পুলিশের অন্দরেও প্রশ্ন, কেন এমন অবিবেচকের মতো কাজ করা হল? যদিও সাংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলার ক্ষেত্রে পুলিশকর্তাদের সুর ছিল ভিন্ন। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষ শুধু বলেন, “যা বলার ‘বড় সাহেব’ (এসপি) বলবেন।” অভিযুক্ত আর এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, “মিথ্যা অভিযোগ করলেই তো হল না! প্রমাণ করতে হবে। আমরা ঘটনার দিন ও সময় কোথায় ছিলাম, তা তো আমাদের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনই বলে দেবে!” ক্লোজ হওয়া অফিসার কার্তিকমোহনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনও মন্তব্য করতে পারেননি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সুপার বলেন, “অতিরিক্ত পুলিশ সুপার যতক্ষণ না তদন্ত-রিপোর্ট দিচ্ছেন, ততক্ষণ এটা আগাম বলা ঠিক হবে না, কে ঘটনায় জড়িত, কে নয়।”
রাজ্য বিজেপির দাবি, অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা ও নারী নির্যাতনের মামলা করে তাদের গ্রেফতার করতে হবে। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ, অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন প্রতিনিধি এ দিন রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পাড়ুইয়ের ঘটনা সবিস্তার জানান। পরে রাহুলবাবু বলেন, “এই বর্বরোচিত হামলায় যে সব পুলিশকর্মী জড়িত, তাদের সাসপেন্ড করার সুপারিশ করার জন্য আমরা রাজ্যপালকে অনুরোধ করেছি। তিনি ডিজি-কে ফোন করে দোষী পুলিশদের সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন।” এর প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্যপালকে কিছু করতে হলে তা রাজ্য সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। তিনি নিজে থেকে কিছু করতে পারেন না।” পার্থবাবু জানান, বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এসপি-কে বলা হয়েছে। যা ব্যবস্থা নেওয়ার তিনিই নিচ্ছেন। এ দিন যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে।
পাড়ুইয়ের সাত্তোর এলাকার বাসিন্দা ওই নির্যাতিতা বধূ দিন কয়েক আগে বর্ধমানের বুদবুদ থানার কলমডাঙা গ্রামে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাসুরপো শেখ মিঠুন সক্রিয় বিজেপি কর্মী, তৃণমূলের উপরে বোমাবাজির ঘটনায় অভিযুক্ত। মিঠুনের খোঁজেই শনিবার সন্ধেয় কলমডাঙায় হানা দিয়েছিল বীরভূম জেলা পুলিশের একটি বিশেষ দল। মিঠুনকে না পেয়ে তাঁর কাকিমাকে গাড়িতে তুলে গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে রাতভর অকথ্য নির্যাতন চালায় পুলিশের দলটি। বধূটির অভিযোগ, তাঁকে গাছে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। হাতের তালু চিরে দেওয়া হয় ব্লেড দিয়ে। সারা শরীরে বিছুটি পাতা ঘষে দেওয়া হয়। কিছু পুলিশকর্মী তাঁর শ্লীলতাহানি করেন বলেও অভিযোগ। পুলিশের সঙ্গে পাড়ুইয়ের কিছু তৃণমূল কর্মীও অত্যাচার চালায় বলে তাঁর অভিযোগ। পরে পুলিশ তাঁকে বেহুঁশ অবস্থায় ইলামবাজার থানায় রেখে যায়।
নির্যাতিতার স্বামীর দায়ের করা দু’টি অভিযোগেই সাত্তোরের ছয় তৃণমূলকর্মীর কথা বলা হয়েছে। পাড়ুইয়ের দাপুটে তৃণমূল নেতা শেখ মুস্তফার ছেলে শেখ আকবর তাঁদের অন্যতম। যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন দাবি করেন, এসপি তাঁদের জানিয়েছেন ওই ঘটনায় পুলিশকর্মী যুক্ত থাকলেও শাসকদলের কেউ জড়িত নন। এই নিয়ে রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “এত প্রভুভক্ত আর মিলবে? এসপি নিজের পুলিশকর্মীকেও কলঙ্কিত করতে রাজি। কিন্তু তৃণমূলকে নন!”
এই ঘটনা নিয়ে সোমবার সন্ধেয় বুদবুদ থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটির বাসিন্দা, সমাজকর্মী বিপ্লবকুমার চৌধুরী। বুদবুদ থানার সঙ্গে ওই ঘটনার যোগ নেই এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ বিপ্লববাবু বলেন, “এ বার অভিযোগ ডাকযোগে পাঠাব। দরকারে সর্বোচ্চ আদালতে যাব।” বিপ্লববাবু এর আগে তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের কুমন্তব্যের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছিলেন। সেই মামলা চলছে হাইকোর্টে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy