বাকসা চৌধুরী বাড়ির দুর্গা প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র।
এই গ্রামের খ্যাতি তার বিখ্যাত এক মিষ্টির জন্য। উপরে চিনির পাতলা আস্তরণ, ভিতরে ক্ষীর। মনোহরা। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন আগে 'মিঠাই নামের একটি সিরিয়ালও হয়ে গিয়েছে।
শক্তিগড় বললেই যেমন ল্যাংচার নাম আসে, বর্ধমান বললে মিহিদানা, ঠিক তেমনই জনাই বললেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নাম আসে মনোহরার। নাম হয়তো শুনেছেন, ট্রেনে যাতায়াতের সুবাদে বর্ধমান কর্ড শাখার জনাই রোড স্টেশনটি দেখেওছেন, কিন্তু সেখানে কখনও গিয়েছেন কি?
পুজোর ছুটিতে কলকাতার ভিড়ভাট্টা ছাড়িয়ে যদি বাংলার আনাচ-কানাচ ঘুরতে যাওয়ার বাসনা থাকে তা হলে বেছে নিতে পারেন এই জায়গাটি। জনাই এখন অজ পাড়াগাঁ নয়, বরং রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগোলে মাঝেমধ্যে চোখ ধাঁধানো বাড়িও চোখে পড়বে। তবে তারই মধ্যে সবুজটুকু একেবারে হারিয়ে যায়নি।
কোনও এক পুজোর সকালে চারচাকাকে সঙ্গী করে কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের দূরত্বে জনাই চলে এলে ঘুরে নিতে পারবেন আশপাশের পুরনো কয়েকটি জমিদার এবং ঐতিহ্যবাহী বাড়ির পুজো।
কলকাতার বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে বা কলকাতার পুরনো বাড়িগুলির পুজোর সঙ্গে এর তুলনা চলে না একেবারেই। তবে ৩০০- ৪০০ বছর ধরে ভক্তিভরে বাড়ির পুজো এগিয়ে নিয়ে চলেছে বর্তমান প্রজন্ম। জনাই এবং বাকসা মিলিয়ে বেশ কিছু পুজো হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, জনাইয়ের কালীবাবুর বাড়ি, বাকসার মিত্র বাড়ি, বাকসার আচার্য বাড়ি, সিংহ বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি, গরলগাছার বাবুদের বাড়ি, বাজার বাড়ি, কত্তাবাড়ি, জলা বাড়ি, গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ি, মুখোপাধ্যায় বাড়ি।
কালীবাবুর পুজো
হুগলির চণ্ডীতলার জনাইয়ে গেলে অবশ্যই দেখে নিতে ভুলবেন না জনাই রাজবাড়ির পুজো। আনুমানিক ২৫০ বছরের পুরনো পুজোর সূচনা করেছিলেন কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এলাকায় তা 'কালীবাবুর পুজো' নামেই পরিচিত।
মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে সামনে উঠোন। উঠোনের চারপাশে বিশাল বাড়ি। সামনেই ঠাকুর দালানে একচালার দুর্গাপ্রতিমা। এই বাড়ির দ্বিতলে যাওয়ার অনুমতি নেই। মাঝেমধ্যে শুটিং হলেও, যত্নের অভাব স্পষ্ট।
চৌধুরী বাড়ির পুজো
জনাই এবং বাকসা জুড়ে যে সব পুজো হয়, তারই মধ্যে একটি চৌধুরী বাড়ির পুজো। দূর থেকে বাড়িটির উজ্জ্বল লাল রং চোখে পড়ে। ভিতরে ঠাকুর দালানে পুজোর আয়োজন। এই পরিবারের সদস্য অসিতবরণ চৌধুরী জানালেন, দিনক্ষণ সঠিক ভাবে না জানা থাকলেও এই পুজো অন্তত ৩০০ বছরের পুরনো। তাঁদের পূর্বপুরুষ রাজারাম চৌধুরী ছিলেন বর্ধমানের রাজার কর্মচারী। রাজপরিবার সূত্রেই বাকসায় ১৬ বিঘা নিষ্কর জমি পেয়েছিলেন তাঁরা। তার পরেই এখানে ধীরে ধীরে কলেবরে বেড়ে ওঠে চৌধুরী বাড়ি। পুজো শুরু হয়।
পরিবারের কুলদেবতা রাধাগোবিন্দ। চৌধুরী পরিবারে দেবী দুর্গা দশভুজা নন, তিনি চতুর্ভুজা। সিংহের রং এখানে সাদা। এই পরিবারের দোল উৎসব খুব বড় করে হয়। জন্মাষ্টমীর পরের দিনই দুর্গাপুজোর খুঁটিপুজো হয়। সপ্তমীর দিন থেকে মা দুর্গার পাশে পরিবারের লক্ষ্মীপ্রতিমা এনে রাখা হয়। তিনিও পুজো পান। দুর্গাপুজোর সময় দুর্গার দু’পাশে রাখা হয় রাধাকৃষ্ণের পারিবারিক বিগ্রহ।
মিত্র বাড়ির পুজো
তেমন জৌলুস নেই। তবে ঠাকুর দালানে এখানে নিয়ম-নিষ্ঠায় পুজো হয় দুর্গার। বাকসার মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজোও বহু পুরনো। পরিবারের অষ্টম প্রজন্মের প্রতিনিধি শক্তি মিত্র জানালেন, তাঁদের পারিবারিক পুজো আনুমানিক ৪০০ বছরের পুরনো। পুজো শুরু করেছিলেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষ পরশুরাম মিত্র। তবে পুজোর সূচনা ঠিক কী ভাবে হয়েছিল, আজ আর অনেকেই জানেন না। একচালায় দশভূজার পূজা হয়। আড়ম্বর না থাকলেও ঠাকুর দালানে পুরনো রীতি মেনেই পুজো হয়। বলি প্রথাও চালু রয়েছে। মিত্র বাড়ির পুজোয় সপ্তমী থেকে নবমী বলি হয়।
জনাই এবং বাকসায় অনেকগুলি পুজো একসঙ্গে হলেও, সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে জায়গাটির বিস্তৃতি খুব বেশি নয়। রাস্তা কিছুটা খারাপ ঠিকই। তবে মোটামুটি ঘণ্টা তিন-চারেকের মধ্যেই জনাই-বাকসার বাড়ির পুজোগুলি দেখে নেওয়া যায়।
আর এখানে এলে মনোহারা চেখে দেখতেই হবে। এখানে অবশ্য ঝাঁ চকচকে বিশাল দোকান নেই। গুটিকয়েক দোকানে মনোহারা বিক্রি হয়। তার মধ্যেও হাতেগোনা কিছু দোকানেই প্রকৃত স্বাদের মনোহরা মেলে।
যেতে কত ক্ষণ সময় লাগবে?
কলকাতা থেকে জনাইয়ের দূরত্ব মোটামুটি ৩০ কিলোমিটার। পুজোর সময় গাড়িতে যেতে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে হাওড়া ব্রিজ পার করে সালকিয়া, কোনা হয়ে ডানকুনি, চণ্ডীতলা, নৈটি হয়ে জনাই।
কোথায় থাকবেন?
জনাই খুব সাধারণ একটি জনপদ। এখানে থাকার জায়গা নেই। কলকাতা থেকে বেশ কাছে হওয়ায় থাকার দরকারও হবে না।
আর কী দেখবেন?
দ্বাদশ শিব মন্দির, বদ্যি মাতার মন্দির ঘুরে নিতে পারেন। আর কলকাতা থেকে আসার পথেই চোখে পড়বে গ্রামবাংলার রূপ। পায়ে হেঁটে আশপাশের গ্রাম, পাড়া ঘুরে নিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy