তাল-এর ভিউপয়েন্ট থেকে
প্রবাসী বন্ধুর সাদর আমন্ত্রণে সপরিবার গিয়েছি ম্যানিলায়। সপ্তাহখানেকের প্ল্যান। দেখব ম্যানিলা শহর ও ফিলিপিন্সের আরও দু’-একটি দ্রষ্টব্য স্থান।
জোনাকির গাছ
প্রথম গন্তব্য পালাওয়ান দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পুয়ের্তো প্রিন্সেসা শহর। ম্যানিলা থেকে প্লেনে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। হোটেলে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। একটু বিশ্রাম নিতে নিতেই পাঁচটা নাগাদ আমাদের ফায়ার ফ্লাই ট্রিপ বা জোনাকি দর্শনের গাড়ি চলে এল। চলেছি শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে একটি সমুদ্রের খাঁড়িতে গাড়ি যখন থামল অন্ধকার হয়ে এসেছে। নেমে দেখি সামনে টিকিট ঘর ও জেটি, সার দিয়ে ডিঙি নৌকো ভাসছে। টিকিট কেটে লাইফ-জ্যাকেট পরে বোটে উঠলাম। ফিলিপিনো বোটচালক দাঁড় টানতে লাগল। প্রথমে ঘন কালো অন্ধকারে চোখ হারিয়ে গিয়েছিল। একটু সয়ে যেতে বুঝলাম একটা খাঁড়ির মধ্য দিয়ে চলেছি। দু’পাশে ঘন ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। মাথার উপরে ঝকঝকে তারাভরা আকাশ। যাকে বলে গর্ভিণী নিস্তব্ধতা। আর একটু ভিতরে যেতেই দেখলাম চারিদিকে জোনাকি ঝিকমিক করছে। কোনও কোনও গাছে দেখলাম অসংখ্য আলোর ফোঁটার মতো জোনাকি জ্বলছে। এ সময়ে বোটচালক চকিতে হাতের টর্চ থেকে একটি গাছে আলো ফেলল, গাছটি মুহূর্তের মধ্যে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। পুরো গাছটিই যেন জোনাকির। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। জোনাকি ছাড়াও বোটচালক চেনালেন আকাশের তারামণ্ডল, দেখালেন গাছে বসে থাকা রাতচরা পেঁচা, আলোর প্রভাবে গুটিয়ে যাওয়া লজ্জাবতীর পাতা, আরও কত কী! প্রকৃতির কোলে এই মুগ্ধ বিহার প্রায় ঘণ্টাখানেক চলেছিল।
পাতাল-নদী
পরের দিন শহর থেকে ঘণ্টা দেড়েকের সফরে সমুদ্রতট, সেখান থেকে বোটে করে সমুদ্র পেরিয়ে এক দ্বীপে যাত্রা। উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে বোট পৌঁছে দিল ছোট দ্বীপটিতে। নেমে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে দ্বীপ পেরিয়ে পাতাল নদীর প্রবেশদ্বার, দেখলাম পর্যটক বোঝাই ক্যানো’গুলি অন্ধকার পাহাড়ের গুহার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরাও একটিতে উঠে পড়লাম।
নদীর নাম পুয়ের্তো প্রিন্সেসা আন্ডারগ্রাউন্ড রিভার। স্থানীয় নাম জানা গেল না। এই নদীতে যাওয়ার পথে পড়ে পুয়ের্তো প্রিন্সেসা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র। গোটা জায়গাটি পুয়ের্তো প্রিন্সেসা সাবটেরিয়ান ন্যাশনাল পার্ক নামে সংরক্ষিত। নদীটি পাহাড় ফাটিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে সাউথ চায়না সি’তে গিয়ে পড়েছে। গুহার মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, বাদুড় ও জলজ প্রাণীতে সমৃদ্ধ বিচিত্র জীবজগৎ। সেইসঙ্গে রয়েছে গুহার গায়ে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জলের অভিঘাতে গড়ে ওঠা স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইটের অপরূপ ভাস্কর্য। ১৯১১ সালে এই নদী পৃথিবীর সাতটি প্রাকৃতিক বিস্ময়ের একটি বলে স্বীকৃত হয়েছে।
গুহার মুখের আলো-অন্ধকার ছেড়ে ভিতরের পিচকালো অন্ধকারের জগতে প্রবেশ করলাম। এখানে বোটম্যানের হাতের টর্চের আলোতে যেটুকু দৃশ্যমানতা। কথা বলা বা ফ্ল্যাশে ছবি তোলা বারণ। মাথার উপরে অনেকটা উঁচুতে গুহার ছাদ, সেখানে অগণিত বাদুড়ের দল ঝুলে রয়েছে। গা-ছমছমে অনুভূতি। ওরই মধ্যে কানে লাগানো হেডফোনে কমেন্ট্রি চলছে। আর-একটু এগিয়ে গুহাটি যেন হঠাৎ প্রসারিত হয়ে গেল। এসে পড়লাম বিশাল এক গুহাকক্ষে। ইটালিয়ান ক্যাথিড্রাল। তার দেওয়ালের পাথরে অপরূপ সব ভাস্কর্য। মনে হচ্ছিল অন্য কোনও জগতে এসে পড়েছি। আরও এগিয়ে ভেজিটেবল মার্কেট। বোটচালক আলো ফেলে দেখালেন প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আনাজ ও ফলের আকৃতির ভাস্কর্য।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়ালাম পাহাড়ের তলায় এই আশ্চর্য জগতে। অনেক কিছুই দেখলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেও ঘোর কাটছিল না।
আগুন-পাহাড়
ম্যানিলা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে তাগায়তাই শহরের পাশে তাল লেকের মধ্যে এক দ্বীপে তাল ভলক্যানো। পুয়ের্তো থেকে ফিরে পর দিন প্রাতরাশ সেরে বন্ধুর গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রাতরাশের কথায় মনে পড়ল, এখানকার খাবারও দারুণ। আগের দিনই চেখে দেখেছি স্থানীয় জনপ্রিয় পদ ফিশ ল্যাপু ল্যাপু। তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর শহর তাগায়তাই। এখানেই ভিউপয়েন্ট। প্রথমে মেঘ থাকায় ভাল দেখা না গেলেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে একসময় মেঘ সরে গিয়ে ফুটে উঠল হ্রদের মাঝে আগ্নেয়গিরির চূড়া। অপূর্ব সেই দৃশ্য।
তাল একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। সাম্প্রতিক কালেও বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। আশপাশের গ্রাম ও শহর খালি করে দেওয়া হয় তখন। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ম্যানিলাতেও ছাই এসে পড়েছিল। এর পর একদিন ম্যানিলা ঘুরে দেশে ফেরার পালা। এ যাত্রায় এটুকুই। এই সুন্দর দেশটির অনেক কিছুই না দেখা রয়ে গেল। বন্ধুকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্লেনে উঠলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy