বিস্তৃত: মশানজোড়ের সৌন্দর্য
রামপুরহাটে আমাদের ছোটমাসির বাড়িটা বড় চমৎকার জায়গায়। বাড়ি থেকে বাসস্টপ আর ট্রেনজংশন দুটোই দেখা যায়। বারান্দার নীচেই তারাপীঠ, শান্তিনিকেতনের বাস দাঁড়িয়ে। পাশের সাইনবোর্ডে কয়েকটা নম্বর লেখা। সেখানে ফোন করলেই গাড়ি এসে নলহাটি বা মুর্শিদাবাদ ঘোরাতে নিয়ে যাবে। ডিসেম্বরের ছুটির বিকেলে এমন পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মনটা পালাই পালাই করে উঠল। ছোটমাসি বললেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডের বাংলা দেখবি? তবে মশানজোড় হয়ে মলুটি গ্রাম চল।’’
পরদিন সকাল ন’টাতেই গাড়িতে উঠে পড়লাম সকলে। রামপুরহাট থেকে সামান্য এগিয়েই ঝাড়খণ্ডের সীমানা। দুমকা রোড ধরে দেড় ঘণ্টা গেলে ময়ূরাক্ষী নদীর উপরে বিখ্যাত জলাধার মশানজোড় বা মাসাঞ্জোর। প্রতিবেশী রাজ্যে ঢুকেই অবাক হয়ে দেখলাম, কী চকচকে রাস্তা! একটু পরে শাল, মহুয়া, পলাশের জঙ্গল ঘন হল, আশপাশে ঘেসো টিলা দেখা দিল। এই হল শিকারীপাড়া। আদিম জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা। ঘণ্টা খানেক পরেই রাস্তা চওড়া হল, টুরিস্ট পার্টি, পিকনিকের বাস দেখা গেল। বুঝলাম, এসে গিয়েছে মশানজোড়।
প্রায় ষাট বছর ধরে ময়ূরাক্ষী নদীর উপরে দাঁড়িয়ে আছে এই ড্যাম। তার উপরে উঠে দেখি, ডান দিকে অনন্ত জলরাশি নিয়ে বইছে ময়ূরাক্ষী। নদীর থেকে বেশি তাকে সমুদ্র বলেই মনে হচ্ছে। নদীর পাড়ে বাঁধানো সিঁড়ি বোটঘাটে শেষ হয়েছে। সেখান থেকে শান্ত নৌকা, দুরন্ত স্পিডবোট ছাড়ছে। তাতে চড়ে নদীর বুকে তুফান তুলে অনেকেই চলেছেন ছোট দ্বীপগুলোয়। কিন্তু ময়ূরাক্ষীর অতলস্পর্শী সবুজ জল দেখে আমার নৌকায় চাপতে সাহস হল না। তবে ভয় কেটে গেল ড্যামের বাঁ দিকটা দেখে। সে দিকেই জলাধার, তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। পাশে সুন্দর সাজানো পার্ক। একপাশে তিরতির করে বইছে নদী। পাড়ে চলছে পিকনিক। জলের উপরের বড় পাথরে পা দিয়ে মজা করে হাঁটছেন অনেকে। ড্যামের উপরেও মজা কম নয়। সেখানে কোলে চেপে ঘুরছে হাতি, বাঘ, সিংহ। আসল নয়, পুতুল। ছবি তোলার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়!
ড্যামের ধারে, পাহাড়ের নীচে স্পেশ্যাল মুড়িমাখা বিক্রি করছিল সাঁওতালি কন্যা। লম্পা গ্রামে তার বাড়ি। রোজ পাহাড় ডিঙিয়ে আসে-যায়। পাহাড়ের চুড়োয় উঠলে তাদের গ্রাম লম্পা দেখা যায় শুনে, আমি পায়ে হাঁটা সরু পথ দিয়ে তরতর করে পাহাড়ে উঠছিলাম। নীচ থেকে সকলে বলল, গাড়ি স্টার্ট দেওয়া হচ্ছে, বিকেলের আগে মলুটি ঢুকতে হবে।
সুপ্রাচীন: মলুটির মন্দিরে টেরাকোটার কাজ
ফিরতি পথে আবার এল শিকারীপাড়ার জঙ্গল। সেখান থেকে মলুটির রাস্তায় গাড়ি বাঁক নিতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। গ্রামের ধার দিয়ে বইছে দুটো নদী— চুমড়ে আর চন্দননালা। তাদের জলহাওয়ায় ঝাড়খণ্ডের রুক্ষ পরিবেশ স্নিগ্ধ হল যেন! রাস্তার উপরেই মৌলীক্ষা মায়ের মন্দিরচত্বর। আবক্ষ দেবীমূর্তি নজরকাড়া সুন্দর। মূর্তির গড়নে বজ্রযানী বৌদ্ধমতের প্রভাব। কয়েক পা দূরেই কিংবদন্তির খনি মলুটি। অখণ্ড বিহারের সাঁওতাল পরগনার মল্লহাটিতে পাঁচশো বছর আগে রাজা বাজবসন্ত নান্কার (করহীন) রাজ্য বসিয়েছিলেন। রাজবংশ ছিল দেবভক্ত, তাঁরা প্রাসাদের বদলে স্থাপন করেছিলেন ১০৮টি অপূর্ব টেরাকোটা মন্দির। সময়ের ঝড়ঝাপটায় এখন ৭২টি অবশিষ্ট। তাদেরও জীর্ণ, ভগ্ন দশা। তবু অপূর্ব সৌকর্য। বেশির ভাগই কালী, শিব ও দুর্গার মন্দির। দুর্গামন্দিরের মাথায় দু’টি সিংহ যেন জীবন্ত। মন্দিরগুলির দেওয়ালে রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহিষাসুরমর্দিনী কাহিনি, মনসার গল্প খোদাই করা। রাসমঞ্চও আছে। সব রক্ষণাবেক্ষণ করছে গ্লোবাল হেরিটেজ ফান্ড, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ, ঝাড়খণ্ড সরকার। গ্লোবাল হেরিটেজ ফান্ডের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের তালিকায় ভারত থেকে নাম তুলেছে মলুটি। ভিনরাজ্যে বাংলার এই এক খণ্ড অতীত বিষয়ে ডকুমেন্টারি তুলতে বিদেশিরা প্রায়ই আসেন। সুন্দর পরিবেশে ছবির শুটিংও হয়। এখানে যে গল্প অফুরান। হস্তিকাঁদা গ্রামে পশুদের তাণ্ডব, মল্লরাজাদের কথা, বড় মন্দিরে বামদেবের সাধনা, বহু দিনের বন্ধ মন্দিরের ভিতরে ঝাড়ুর শব্দ, তান্ত্রিকদের উপাখ্যান, প্রস্তরযুগের অস্ত্রের স্তূপ— সব দেখেশুনে নিতেই দিন ফুরিয়ে গেল। নদীর ও পার থেকে হিমেল আদিম হাওয়া এসে জানান দিল, কে বলে শহর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে? আসলে বহু যুগ দূরে দাঁড়িয়ে আছি।
শীত বাড়ছে। গাড়িতে উঠে পড়লাম। মিনিট কুড়িতেই এসে গেল ব্যস্ত টাউন রামপুরহাট। নাকি ফিরে এলাম একুশ শতকে?
ছবি: নীলাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy